বুড়ীর মনেও দেবতার ভয় কম নয়। কিন্তু মনের কতোটুকু তার নিজের এখতিয়ারে। সমুদ্রের মতো গভীর তলদেশ থেকে নোনা ঢেউ উঠে ছেয়ে যায় মন। দেবতা, স্বর্গ, ধর্ম সবকিছুর বিরুদ্ধে সগ্রাম করে অবচেতন মন। কখন যে হরিমোহনের ধর্মান্তরকে নিজের অজান্তে মাফ করে দেয় নিজেও বলতে পারে না। মনে মনে হরিমোহনের পক্ষ সমর্থন করে অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে লড়তে লেগে যায়।
নিজের যৌবন-দিনের কথা মনে পড়ে। তখনো শৈলবালার বিয়ে হয়নি। সারা শরীরে সঙ্গীতের রেশ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘুমের মধ্যে কে যেন সারা শরীরে সোহাগের হাত বুলিয়ে দিয়ে যেতো, স্বপ্নের মধ্যে কে আসতো? কার মুখ, কার দুটো শান্ত চোখের দৃষ্টি বিধে থাকতো বুকের ভেতর? ফর্সা গৌরবর্ণ, একহারা চেহারার সে পূজারী ব্রাহ্মণের ছেলেটি যদি একবার ইঙ্গিত করতো, যদি একবার মুখের দিকে চেয়ে হেসে কথা কইতো, এ জীবনকে কি ধন্য মনে করতো না? তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো, নয় তো শৈলবালাও কি ঘটাতো না অঘটন? ব্রাহ্মণের ছেলে কতোদিন থাকতে পারতো অচঞ্চল? একদিন তার বুকের জল কি ছলকে উঠতো না? সেও কি দু’খানা বাহু মেলে শৈলবালাকে ব্যগ্র আলিঙ্গণ করার জন্য ছুটে আসতো না? কায়স্থের মেয়ে হয়ে ব্রাহ্মণের সন্তানকে কামনা করা যদি পাপ না হয়, হিন্দু হয়ে মুসলমানের মেয়েকে চাইতে দোষটা কোথায়, বুড়ী খুঁজে পায় না। আর যদি দোষ হয়ে থাকে, সে দোষ মা-ছেলে দুজনেরই। তারই গোপন কামনা হরিমোহনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। ধর্ম মাথায় থাক, দেবতা মাথায় থাকুন, পাপী মা পাপী সন্তানের জন্য কাঁদবেই। বুড়ী এভাবেই বিচার করে।
হাফিজের মা দুধ দিতে এসে সুফিয়ার মৃত্যু-সংবাদ দিয়ে গেছে। বুড়ী কাউকে না বলে লাঠির আগায় ভর করে আস্তে আস্তে হাসিমের ঘাটার গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো। আর ভেতরে যেতে পারে না। জীবনে কোনো মুসলমানের মৃতদেহ দেখে নি। দেখার রেওয়াজ নেই। হিন্দুরা মুসলমানের মৃতদেহ দেখতে যায় না। মুসলমানেরাও দেখে না। অন্তরের টানে এতোদূর চলে এসেছিল এখন ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। হিন্দু পাড়ার কেউ না কেউ দেখে ফেলবে। হেনস্থার অন্ত থাকবে না তখন। কেন এলো বুড়ী ভেবে পায় না। মনে মনে দুর্গা নাম জপ করে। মানুষ আসছে ভেতর থেকে, মানুষ যাচ্ছে ভেতরে। ওপাড়ার অপরিচিত বউ-ঝিরাও এসে দেখে যাচ্ছে সুফিয়াকে। অথচ বুড়ীর আপনজন, নাতবউ, নিজের গর্ভের মেয়ের মতো ভালোবাসতো। কিন্তু তার একটিবার চোখের দেখা দেখার অধিকার নেই। এই প্রথম মনে মনে আকাশের ভগবানকে দোষী করলোঃ
“ভগবান, দুই ধর্ম কিয়লায় ছিরজন গুরলি?” (ভগবান, তুমি দুই ধর্ম কেন সৃষ্টি করলে?)।
আমগাছটার নীচে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ী। চোখ দুটো ছলছল করছে। যে সকল বউ-ঝি মরা সুফিয়াকে দেখে চলে যাচ্ছে তাদের দিকে বোবা দুটো চোখ বিছিয়ে রাখে। ওরা একেকবার তাকায়। কারো কারো চোখ বেয়ে মমতা ঝড়ে পড়ে। একজন বলেঃ
“পোদ্দারের বউ, নাতি-বউয়ের মরণের খবর হুনি আস্যেদে, লউয়ের টান তো থাহিত ন পাড়েদে আর। (পোদ্দার গিন্নী নাতবউয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে এসেছে। রক্তের টান তো, আর থাকতে পারে নি।)
বুড়ীর ভারী খারাপ লাগে। এমন অবস্থার মধ্যে জীবনে কোনোদিন পড়ে নি। এ খবর যদি হিন্দু পাড়ায় ছড়িয়ে যায়, তার প্রতিক্রিয়া কি হবে ভাবতেও হৃদযন্ত্রের ধুকধুকানি থেমে যেতে চায়। পুকুরের পূর্ব পাড় বেয়ে চার-পাঁচ জন লুঙ্গিপড়া মানুষের সঙ্গে ধুতি পড়া আসছে সে কে? অধর– অধর নয়তো? ভয়ে সর্বশরীরে খিল ধরে যাবার উপক্রম। আসছে এদিকে। বুড়ী মনে মনে বলে, “মা দুর্গা, আঁর কি দশা অইব?” এখন দেখে ফেলবে, খবর রাষ্ট্র হয়ে যাবে। পূর্ব পাড় পেরিয়ে উত্তর পাড়ে উঠলো ওরা। আর বেশি দূরে নয়, এক্ষুণি এসে পড়বে। দেখে ফেলবে। এদিক ওদিক তাকায়। কোথাও লুকোবার স্থান নেই। ওরা এগিয়ে আসছে। বুড়ীর বুকের ভেতর মাদল বেজে যাচ্ছে। চারা আমগাছটার পেছনে এসে শাড়িটা লম্বা করে ঘোমটা টানলো। বুড়ীকে দেখলে দেখুক যেন বুড়ী না দেখে। ধুতিপরা মানুষটি লুঙ্গিপরা চার-পাঁচজন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চারা আমগাছটার তলাতে এসেই ডাক দিলঃ
“আঁর কি দশা অইব মা দুর্গা? (মা দুর্গা, আমার কি দশা হবে?)
“হেইভা কন, ঠাউর মা না? খাড়াই ক্যা রইয়ো–আইয়ো–আইয়ো।” (ওটা কে, ঠাকুর মা না? দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন? এসো৷)
বুড়ী ঠক্ ঠক্ করে কাঁপে, এক্ষুণি বুঝি লাঠিটা হাত থেকে খসে পড়ে যাবে। বুড়ীর মুখ দিয়ে কোনো কথা সরে না। ধুতিপরা লোকটি হিমাংশু বাবু। এগিয়ে এসে বুড়ীর হাত ধরে। সস্নেহে বলেঃ
“ঠাউর মা তুই আমতলাত ক্যা? আইয়ো নাতির বউরে চাই ল শেষ বারের মত।” (ঠাকুর মা তুমি আমতলায় কেন? এসো, নাতির বউকে শেষবারের মতো দেখে নাও।)
হিমাংশুবাবুর পেছন পেছনে বুড়ী উঠোন পেরিয়ে মৃতার শয্যার পাশে চলে আসে। সুফিয়ার ফুফাতো বোন শিয়রে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিলো। বুড়ীকে দেখে রাগ করে পড়া বন্ধ করে উঠে গেলো। মেয়েদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠলো। মুর্দার ঘরে হিন্দু এসেছে, সুতরাং ফেরেস্তা আসবে না। বুড়ী কানে কম শোনে। তা ছাড়া মেয়েদের ঠারের কথা বোঝার মতো সজাগ ইন্দ্রিয়ও বুড়ীর নয়। পুরুষদের মধ্যেও দু’একজন আপত্তি করেছিলো, কিন্তু মনির আহমদ বললোঃ