“মা, তুই বউত গরলি। পরের লায় পরে এতো ন গরে আইজ-কাইল। (মা, অনেক করলি, পরের জন্য পরে এতে করে না আজকাল।)
“পরে কন?” (পর কে?) জিজ্ঞেস করে জোহরা।
জবাব দিতে পারে না বুড়ী। ধারালো বাঁশের ফালি দিয়ে কচ কচ করে কেটে দেয় নাড়ী। চিরকি দিয়ে, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। ক্ষরণ! ক্ষরণ! কিছুতেই বন্ধ হয় না। ওঃ সে কি রক্তক্ষরণ সুফিয়ার। হাসিম আর দেখতে পারে না চোখ দিয়ে। সংজ্ঞা তার লোপ পেয়ে যাচ্ছে। দু’হাতে মাথার যন্ত্রণারত শিরা দুটো চেপে ধরে বসে পড়ে। সুফিয়া ক্ষীণ কণ্ঠে বলেঃ
“এককেনা পানি।” (একটু পানি।)
জোহরা মাটির সোরাহীর নলটা এগিয়ে ধরে। এক চুমুকে নিঃশেষ করে ফেলে সবটা। আরো চায়, আরো। তার বুকের ভেতর প্রচণ্ড তৃষ্ণা। দু’চারটা সমুদ্র শুষে নিতে পারে। ইশারায় হাসিমকে কাছে ডাকে। হাসিম বিছানার ধারে এগিয়ে যায়। তার দু’চোখে পানি। সুফিয়া নবজাতকের নরম চুলে হাত বুলোয়। তারপর খুবই ক্ষীণ কণ্ঠে বলেঃ
“তোঁয়ার হাতখান দেও। আঁই আর বাঁইচতাম নয়।” (তোমার হাতখানা দাও। আমি আর বাঁচবো না।)
হাসিম সুফিয়ার হাতখানা তুলে নিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। সুফিয়া হাসিমকে শেষবারের মতো আবদার করেঃ।
“আঁরে কবর দিও মার পাশে।” (আমাকে মায়ের পাশে কবর দিও।)
সুফিয়ার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে এসেছে। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হতে ক্ষীণতররা। এক সময় খুব করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেঃ
“আসমান লাল অইয়ে না? কুড়ায় বাঙ দিয়ে না?” (আকাশ কি লাল হয়েছে? মোরগ কি ডাক দিয়েছে?)।
নবজাতকের রক্ত আবরণের মতো লাল হয়েছে আকাশ। সুফিয়া বোধ হয় শুনলো, বোধ হয় শুনলো না। লাল আসমানের দিকে চেয়ে চুপ হয়ে গেলো চিরদিনের মতো। একখানা হাত নবজাতকের শিয়রে পড়ে রইলো। নিপ্রাণ সুফিয়ার দু’চোখে কিসের জিজ্ঞাসা? কিন্তু চিবুক দুটি কি আশ্চর্য রকমের দৃঢ়, প্রতিজ্ঞায় পাষাণ।
৭. হাসিমের বুড়ো দাদী
হাসিমের বুড়ো দাদী আপন গর্ভজাত ছেলের মরা মুখ দেখতে পায় নি। যে ছেলে মেয়েমানুষের মোহে পড়ে বাপ-পিতামহ চৌদ্দ পুরুষের ধর্ম ছেড়ে যেতে পারে, আপন ছেলে হলেও তার মুখ দেখা যে পাপ। পাপবোধের বিরাট বাধা জননীর অন্তরের প্রবল শোকাবেগের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলো। আপনজনের বিয়োগে শরীরের অণু পরমাণু থেকে সঙ্গীতের করুণতম মুছনার মতো যে ব্যথা ঝরে যায়, সমস্ত স্নায়ু-শিরা বিকল করে দেওয়া সে ব্যথার প্রকাশ-পথও রুদ্ধ করেছিলো সমাজ। জননী একবার জনসমক্ষে উঁহুও করতে পারে নি। পেটের ছেলে হোক, তবু তো মুসলমান। মুসলমানের জন্য চোখের জল ফেলাও পাপ। শাস্ত্রে মহত্তম পরজন্ম থেকে অক্ষয় স্বর্গবাস পর্যন্ত সবকিছুর বিধান মেলে। ‘রেলের লাইনের মতো পাতা’ শাস্ত্রীয় পথ ধরে এগুলে সিঁড়ির পর সিঁড়ি ডিঙিয়ে, স্বর্গলোকের দ্বারে পৌঁছুনো যায়–কিন্তু হৃদয়ে যে ব্যথা গুমড়ে ওঠে, জননীর অন্তরে যে শোক মাথা কুটে মরে, শরীরের কোষে যে ক্রন্দন মর্মরিত হয়–তার নেই কোনো নির্গমন পথ।
বুড়ী শৈলবালা বাড়ির পেছনের পুকুরের পশ্চিম পাড়ে গিয়ে দেখলো তার কনিষ্ঠ সন্তান হীরাধরের নিপ্রাণ দেহ শাদা চাঁদরে ঢেকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কবরখানার দিকে। তারা তার ছেলের দেহ মাটি চাপা দিলো। তাজা কবরের দিকে চেয়ে বুড়ীর মনে কি ব্যথা উথলে উঠেছিলো সে খবর কেউ জানে না, কেউ না। একবার গলা ছেড়ে ডুকরে কেঁদেও উঠতে পারে নি। শোক বুকের ভেতর জমে জমে পাথরের চাঙ্গড়ের মতো কঠিন হয়েছে। সামাজিক সহানুভূতিহীন এই যে পুত্রশোক তার কি ভার! কোনোদিন কারো কাছে বলে একটু হালকা করারও অবকাশ পায় নি। রাতের অন্ধকারে বুড়ীর দু’চোখ বেয়ে হু হু করে নেমে আসে জলের ধারা। হরিমোহনের শিশুকালের চেহারাটি চোখের সামনে ভাসে। টানা টানা চোখ, শ্যামলা গড়ন–অবিকল যেন যশোদা-নন্দন বালগোপাল। ননীময় দু’খানি ছোট্ট হাত প্রসারিত করে মা মা বলে ডাক ছেড়ে তার কোলে ওঠার জন্য ছুটে আসছে। কখনো ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে, যুবক হরিমোহন যেন বলছে, “মা, আমি হিন্দু হই, মুসলমান হই, আমি তো তোরই সন্তান। কোলে তুলে নে রে মা, কোলো তুলে নে।”
যতই দিন যাচ্ছে হরিমোহনের বিয়োগ-ব্যথা কঠিন হতে কঠিনতরো হয়ে বাজছে বুড়ীর বুকে। প্রতিদিন প্রতিরাত বেদনার নীরব সারেঙির মতো পুত্ৰশোক তার সারা শরীরে হু হু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়। মাঝে মাঝে রক্তসন্ধ্যার রাগিনী বিছানো পথের দিকে শোকার্ত দু’চোখের দৃষ্টি মেলে দিয়ে বুড়ী ভাবে, হয়তো আবার হরিমোহন শিশু হয়ে তার কোলে ফিরে আসবে, আধো আধো স্বরে মা বলে ডাকবে, নতুন স্নেহে আবার ছেলেকে বুকে বাঁধবে, দুই স্তন বেয়ে দুধের ধারা উছলে উঠবে। সন্ধ্যার কালো লোমশ অন্ধকারের প্লাবন এসে সূর্যের অস্তগিরির ওপারের সব সম্ভবের দেশে যাবার আবীরের রঙে রাঙা পথরেখা মুছে দিয়ে যায়। কালো শালের মতো আকাশে চুমকির মতো নক্ষত্রেরা জ্বলে। মুসলমান হয়ে যাওয়া ছেলের মৃত্যুশোক বুড়ো হাড় পর্যন্ত ব্যথিয়ে তোলে বুড়ীর। বেদনায় ছেয়ে যায় সমস্ত অন্তর। কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে নি… পারবে না কোনো দিন। কেউ সমবেদনা দেখায় নি, দেখাবে না। বরঞ্চ হরিমোহনের মৃত্যু যেন সমাজের মানুষের কাছে ধর্মত্যাগের দণ্ড বিশেষ। রামাই পণ্ডিত দু’একবার কথা-প্রসঙ্গে নাটমন্দিরে বসে বলেও ফেলেছে, চৌদ্দ পুরুষের ধর্ম যে এমনি করে ছেড়ে যেতে পারে, দেবতারা তাকে এমনি দুঃখ দিয়েই শাস্তি দিয়ে থাকেন।