“কি অইত থাহিলে?” (থাকলে কি হতো?) অসহিষ্ণু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে হাসিম।
“খালাস ন অন পর্যন্ত মাথার চুল পানিতে ভিজাই রাইখতো। তাহলে ব্যথা কম লাগতো।” (খালাস না হওয়া পর্যন্ত মাথার চুল জলে ভিজিয়ে রাখতো, তাহলে ব্যাথাটা কম লাগতো।)
জোহরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে একটা বড় থালার মধ্যে পানি ঢেলে মাথার চুলগুলো পানির ভেতর ডুবিয়ে, মাথা নীচু করে রইলো। প্রত্যেক নিশ্বাসে কণ্ঠ চিরে ঝরছে, আল্লাহু, আল্লাহু।
ঘরের ভেতরে চলছে যমে আর মানুষে টানাটানি। সুফিয়ার জরায়ু ফেটে চির চির করে টাটকা তাজা রক্ত নির্গত হচ্ছে। এ রক্ত ছদুর রক্তের মতো নয়, আরো লাল, আরো গাঢ়, আরো তাজা। মনের ভেতর প্রবল আবেগের তোড়ে হঠাৎ যখন উষ্ণ কিছু, তরল কিছু ঝরে পড়ে আর হৃৎপিণ্ডটা দুলে ওঠে, চোখে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় রক্তিম কিছু ঝরে গেলো, তেমনি লাল জরায়ুর রক্ত। নতুনের সৃষ্টির এমনি রক্তরাঙা পথ। আতঙ্কিত প্রাণে বিচিত্র ভাবনায় ঝলকে ঝলকে জেগে ওঠে। এ রক্ত আরো এক স্মরণাতীত রক্তঝরা দিনের কথা তার স্মরণে টেনে আনে। সেও কি অতীতের এমনি এক রাতে রক্তস্নানে শুভ্র হয়ে পৃথিবীর আলোতে পরম বিস্ময়ে চোখ মেলেছিলো?
প্রহরে প্রহরে গড়িয়ে যাচ্ছে রাত। রাতের নদী ছুটছে… ছুটছে। ঘরের চালে ডাকছে দুটো কানাকুয়ো পাখি। বাদুড়ের ঝটপট পক্ষবিধুননের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। আকাশের বোবা তারার চোখ বেয়ে সুফিয়ার উদ্দেশ্যে নীরব সহানুভূতি শিশির হয়ে ঘাসে ঘাসে ঝরে পড়ছে নীরবে। নারকেল গাছ থেকে ভূতুমটা বিরাট পাখনা মেলে দিয়ে ঘরের খড়ড়া চালে এসে বসলো। অশুভ ডাক ডাকছে ভূতুম। বড় গম্ভীর স্বর। আতঙ্কে অন্ধকারও চমকে ওঠে। হৃৎপিণ্ডের চঞ্চল প্রবাহে জমাট আস্তরণের মতো জমে থাকে। কেঁপে ওঠে বুকের ভেতরটা। অন্ধকারে ভূতুম… অন্ধকারের শব্দ ছড়ায়।
ঘরের ভেতর কেরোসিনের মিটিমিটি শিখা অস্তিত্ব রক্ষা করে টিকে আছে কোনো মতে। বাইরে চাপ চাপ অন্ধকারের মসীকৃষ্ণ যবনিকা। ঘরে কেঁদে যাচ্ছে প্রসব বেদনাকাতরা এক নারী। পেটের ভেতরের সন্তান তাকে হত্যা করার নেশায় পাগল হয়ে উঠছে। যে সন্তান রক্তের ভেতর, মাংসের ভেতর, কল্পনার ভেতর, স্বপ্নের ভেতর অণু অণু রেণু রেণু হয়ে মিশেছিলো আজ বাইরে বেরোবার সোজা রাস্তা না পেয়ে জননীকেই হত্যা করতে চাচ্ছে প্রবল আক্রোশে। মানুষের কল্পনা– ভাবনাও মানুষকে ক্ষমা করে না। প্রকাশের পথ চায়, না পেলে জল্লাদের বেশে প্রাণ নিয়ে টানাটানি করে। উদরস্থ সন্তান উদরের ভেতরেই বিদ্রোহ করেছে। তার সারা শরীরে ভূমিকম্প জেগেছে। ভয়াবহ নীরবতা। ক’জন মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠ প্রাণপণ প্রচেষ্টায় ভয়াবহ নীরবতাকে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সহস্র লোমশ থাবা মেলে দিয়ে ভয়ঙ্করের বেশে এগিয়ে আসছে। বিশ্ব-চরাচরের সবকিছু গ্রাস করে ফেলবে বুঝি।
সমুদ্রের জোয়ারের মতো বার বার সুফিয়ার তলপেট তরঙ্গায়িত হয়ে উঠছে। উদরের অভ্যন্তরে সে রক্তখেকো তিমি মাছটি ঘাই মারছে। ঘাই মারছে প্রচন্ড বেগে। অনেক শক্তি তার। নিজের ছোট্ট পৃথিবীতে অসম্ভব বলতে কিছু নেই। সব করতে পারে সে। তাকে বাইরে টেনে আনতে হবে। মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই থামবে না। সুফিয়ার জরায়ুতে রক্ত ভাঙছে। এতো রক্ত সুফিয়ার! খলু মাতব্বরের দাঙ্গায়ও অতো রক্ত ঝরে নি! অতো রক্ত ছদুর শরীর থেকেও ক্ষরণ হয় নি! ছদু মারা গেছে। আশ্চর্য সুফিয়া এখনো জ্ঞান হারায় নি। জ্ঞান হারাতে পারে না সে। অন্তরের ছোট দেবতাটি আগে শরীর চিরে, জরায়ু ভেদ করে বেরিয়ে আসুক। পৃথিবীর আলোতে সন্তান চোখ মেলুক- এই-ই তো সে চায়। বুড়ো বয়সে হাসিমের বাপ যেমন মুসলমান হয়েও কালীবাড়ীর পাশ দিয়ে যাবার সময় অভ্যেসবশে মাকালীকে ভক্তি জানাতে চুপিচুপি; সেও তেমনিভাবে অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে সালাম করলো সুফিয়াকে। সুফিয়া কাঁদছে। তার শরীরে আর সইছে না।
“ঝি রে, শান্ত অই আল্লাকে ডাক। তিন ভূবনের মালিক আল্লাহ্। আল্লায় আসান গরিব।” (ঝি, শান্ত হয়ে আল্লাহকে ডাক। তিন ভূবনের মালিক আল্লাহ্। আল্লাহ্ আসান করবে।)
ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে পড়ছে করিম বকসুর মা’র কথা, নরম ঘুমপাড়ানি গানের মতো মেদুর।
রাতের আকাশে তারাগুলো সব মরে গেছে। সমগ্র পৃথিবীকে আঁধার ভালুকের মতো চেপে ধরেছে… ভূতুমের স্বর আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বাদুড়ের আওয়াজ মরে গেছে। সুফিয়ার আর্ত-চীকারে সহসা জমাট অন্ধকার কেঁপে উঠলো।
ওঁয়া ওঁয়া ডাক ছেড়ে নতুন শিশু কেঁদে উঠলো।
পৃথিবীতে আসার প্রথম আনন্দ, প্রথম বেদনা। সুফিয়ার ক্লান্ত ম্লান মুখমণ্ডলে একটা পরিতৃপ্ত হাসির ছটা বিকিরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বড় দুঃখের, বড় আনন্দের; কিন্তু বিজয়ের সে হাসি। মাটির অধিকারের জন্য হাত-পা ছুঁড়ছে নবজাতক। রক্তের লাল বসনে আবৃত সারা শরীর। আঁধার কেটে গেছে। পুবে ধল পহর দেখা দিয়েছে। সিঁদুর রেখার মতো বিনম্র আলোর একটা ঈষৎ রেখা জাগলো। তারপরে লাল হয়ে উঠলো আকাশ। নবজাতকের রক্তাক্ত বসনের মতো লাল।
থালা হতে মাথা তুলে নিলো জোহরা। ঘাড়টা ব্যথা করছে। চুল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরছে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে নবজাতকের দিকে চেয়ে রইলো। একটি রক্ত-মাংসের পিণ্ড… তার ভেতরে প্রাণ। সে প্রাণ নড়ে উঠছে। পাতলা ছোট্ট দু’খানি ঠোঁট। স্লান একখণ্ড মেঘ মনে জেগে ছেয়ে ফেলে মনের আকাশ। দু’ফোঁটা পানি ঝরে পড়ে। করিম বকসুর মা মন্তব্য করেঃ