কেঁদে ফেলে হাসিম। অতো স্নেহ, অতো প্রেম, অতো ভালোবাসা কোনো কাজে আসবে না তার। তারই তৃষ্ণার আগুনে সুফিয়ার উদরের ভেতর রক্ত হতে রক্ত, প্রাণ হতে প্রাণ টেনে নিয়ে যে শিশু বেড়েছে দিনে দিনে, সে অনাগত শিশুর কাছে হাসিম আজ শুধু অবাঞ্ছিত জনক। দুঃখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কেন, জানে না। এ বিপদের সময়ে জোহরার কথাই তার মনে এলো। সুফিয়া জোহরাকে সাহায্য করতে পারে। একদৌড়ে ছুটলো। বেশি দূর যেতে হলো না। পুকুরের পাড়ে দেখা পেলো। হাসিমের বুক টলছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। রা সরছে না আতঙ্কে।
“অ জোহরা।”
জোহরা হাসিমকে কোনো দিন অমনভাবে ডাকতে শোনে নি। চমকে ওঠে। গভীর জঙ্গলের অন্তরালে বাঘের থাবায় বিক্ষত মানুষের কণ্ঠ চিরে যে স্বর বেরোয়, তেমনি স্বর হাসিমের।
“কি হাসিম বাই?”
“বইন বাঁচা, সুফিয়ার ব্যথা উইঠ্যে।” (বোন বাঁচাও, সুফিয়ার ব্যথা উঠেছে।) ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে হাসিম শিশুর মতো। কলসীটা ঘাটে ডুবিয়ে তড়িঘড়ি এসে গেলো জোহরা। কিছু ভেবেও দেখলো না। তাড়াতাড়ি একখানা দড়ি টাঙিয়ে সুফিয়ার পা দুটো দড়ির ওপর তুলে দিলো। বেদনা একটু কম লাগবে। কেননা, পা দুটো ওপরে থাকলে অন্ধকারেও নবজাতকের পথ চিনতে অসুবিধা হবে না।
“বাই, তুঁই তাড়াতাড়ি করিম বকসুর মারে ডাকি লই আইয়ো মুন্সী পাড়া যাই। আর ধাই নাই এই দেশত।” (ভাই, তুমি তাড়াতাড়ি মুন্সীপাড়া গিয়ে করিম বকসুর মাকে ডেকে নিয়ে এসো। এই দেশে আর ধাত্রী নেই।)
.
ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর হাসিম ছুটলো। একটা ঢোঁড়া সাপের মাথা পায়ের তলায় পড়ে ঘেঁচে গেলো। গলে একটা ব্যাঙ চ্যাপ্টা হয়ে গেলো। করিম বকসুর মা’র দুয়ারে করাঘাত করে। ওদিকে অনাগত শিশুও তেমনি প্রচণ্ড জোড়ে সুফিয়ার জরায়ুর দ্বারে আঘাত হানছে। সে শিশু আরো নিষ্ঠুর, আরো হৃদয়হীন। কখনো পৃথিবীর আলো দেখে নি প্রবল আলোর পিপাসা, বায়ুর পিপাসা, জলের পিপাসায় কাতর শিশু বার বার রুদ্ধ আবেগে লাথি মারছে। অন্ধকারে সুফিয়ার হৃদপণ্ডের ধ্বনি জেগে থাকে। তার অমন আদরের বৌ সুফিয়ার কাঁচা তাজা জানখানা আঁচলের গিঠে বেঁধে দুষ্ট বুড়ী যেন ঘুমিয়ে আছে। হাজার ডাকেও রা করে না। বেড়ায় দুম দুম লাথি মারতে থাকে।
“কন পোড়া কোয়াল্যা এত রাইতত আবার মরিবার লায় আইল। মাইনষের আর কন কাম নাই, পোয়া বিয়ান ছাড়া।” (পোড়া কপাল কার, এতো রাতে আবার মরতে এলো। ছেলে বিয়ানো ছাড়া মানুষের আর কোনো কাজ নেই।)
কাঁচা ঘুম থেকে উঠে বুড়ী গালাগাল করে। একে তো বুড়ো শরীর। তাতে বাতের ব্যথা নেমেছে। বাম হাত, বাম পা একেবারে অবশ হয়ে এসেছে। নড়তে চড়তে পারে না। তুষের মালসায় ফুঁ দিয়ে পাটকাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করেঃ
“হেইভা কন?” (ওটা কে?)
“আঁই দাদী।” (আমি দাদী।) হাসিমের কণ্ঠে সেই অসহায় ব্যাকুলতা।
“অ বান্যিয়ার পুত, খাড়া। কি খবর?” (ও বেনের ছেলে, দাঁড়া। কি খবর?)
‘দাদী, দাদী, এককেনা আইয়ো। সুফিয়া বাঁইচত নয়। কইছালি গরেরদে। [দাদী, দাদী, একটু এসো। সুফিয়া বাঁচবে না। কইছালি (কই মাছে ছাই মাখালে যেমন করে) করছে।
“অলক্ষণ্যা কথা ক্যা কলি গোলাম্যার পুত, তোবা গর, তোবা গর। বাঁইচত ন ক্যা?” [গোলামের ছেলে (গালি অর্থে), অলক্ষুণে কথা বললি কেন? তোবা কর অর্থাৎ আর কোনদিন বলবি না বল।]
বুড়ী হাসিমের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। তালাটা এঁটে দিতেও ভুলে যায়। অন্ধকারে দেখতে পায় না। ব্যথায় পা ঝিমঝিম করে। মা রে, বাপ রে চীকার করে। অসহ্য হাসিমের অসহ্য লাগে। পিঠের মাঝ বরাবর একটা কিল মেরে কুঁজো বুড়ীকে সোজা করে দিতে ইচ্ছে করে। কতদূর এসে বুড়ীকে হেঁচকা টানে কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে বিলের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে। উঁচু-নীচু জমি। আলে ঠোক্কর লাগে। পানিতে ঝপাঝপ শব্দ হয়। করিম বকসুর মা’র ডর করে। চীকার করে উচ্চস্বরেঃ
“গোলাম্যার পুত আস্তে যা, আস্তে–মারি ফেলালি।” (গোলামের ছেলে, আস্তে আস্তে চল; মেরে ফেললি।)
ঘরে এসে নামিয়ে দেয় করিম বকসুর মাকে। পা দুটোকে মুখের থুথু দিয়ে মালিশ করলো। তারপর এগিয়ে গেলোলা প্রসূতির শয্যার দিকে। হাসিম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। জোহরা আর করিম বকসুর মা কাজে লেগে যায়। সুফিয়ার চীৎকারে পাড়াপড়শীর ঘুম ভেঙে গেছে। নারীর প্রসব বেদনার কান্না শুনে কোনো নারী কি বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে? একজন একজন করে তারা সুফিয়ার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাক্য নেই। এ সেই মহা পরীক্ষা, যাতে উত্তীর্ণ হয়ে নারীজন্ম সার্থক করতে হয়। এর জন্য দশটি মাস অতন্দ্র প্রহর গুণতে হয়। কে একজন হাসিমকে খালাসী পানি পড়ার জন্য জহির মৌলবীর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলো। গেলাস হাতে ছুটলো। কোরআনের আয়াত পড়া পানি প্রসূতির দুরান আর জরায়ুতে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। কষ্ট কমছে না একটুও। আবার তাবিজ আনতে ফয়েজ মস্তানের বাড়িতে গেলো হাসিম। প্রসূতির রানে আল্লাহর কালাম লেখা তাবিজ বেঁধে দিলো। কষ্ট কমছে না। যে ভূমিকম্পে পাষাণ ফেটে যায়, ভূ-পৃষ্ঠের পর্বত তলিয়ে যায়, তেমনই ভূমিকম্প সুফিয়ার শরীরে। কে একজন আক্ষেপ করে বললোঃ
“আহা, আজি যদি মা, ভইন থাইকতো।” (আহা, আজ যদি মা, বোন থাকতো।)