“আঁরা এক থাইক্কম। ক্যারে জমিনে দাগ লাগাইতম দিতাম নয়।” (আমরা এক থাকব, কাউকে জমিতে দাগ লাগাতে দেব না।) একসঙ্গে সমবেত জনতা সায় দিলো।
.
মনির আহমদ বসে পড়লো। সমবেত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে প্রচণ্ড উত্তেজনা। আশ্চর্য! হাসিমের আশ্চর্য লাগে। ধৈর্য ধরে পাথরে আঘাত করতে করতে কোত্থেকে আগুন টেনে নিয়ে এলো যেন মানুষটা। তার শরীর ঘামছে। গায়ের খয়েরী রঙের হাফ শার্টটা গায়ের সঙ্গে লেগে গেছে। হাসিম একখানা হাত পাখা হাতে এগিয়ে এসে মনির আহমদকে বাতাস দিতে থাকে।
উত্তেজনার জের একটু কমে এলে ভির ঠেলে ময়মুনার বাপ মনির আহমদ আর কেরামত আলীর সামনে বসে অসঙ্কোচে বলেঃ
“বা’জান, একখানা কথা পুছ গইরতাম চাইরদে, কন, রাগ গরিবানি বাজান?” (বাপজান একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি, শুনে কি রাগ করবে বাপ?)।
“না, না, রাগ কীয়র চাচা, পুছ গরন না। মনে যা চায়।” (না, না রাগ কিসের, জিজ্ঞেস করুন, যা আপনার মন চায়।) ময়মুনার বাপকে অভয় দেয়। জায়গা করে বসতে দেয়।
“বাজান, আঁরা যুদি বাধা দি, তইলে দারোগা-পুলিশ আই ধরি নিলে কি গইরগম বাজান? বউ-বেটারে বাঁচাইবার লায় আল্লাহ গতর ছাড়া আর কিছু ন দে। তোঁয়ার কথা হাঁছা কিন্তু বাজান ডর লাগে।” (বাপজান, আমরা যদি বাধা দেই, তা হলে তো পুলিশ-দারোগা এসে ধরে নিয়ে যাবে। তখন কি করবো বাপ? বউ-ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তো আল্লা গতর ছাড়া আর কিছু দেয় নি। তোমার কথা সত্য কিন্তু বড় ভয় লাগে।)
একমাত্র গতর যাদের সম্বল তারা দারোগা-পুলিশকে ভয় করবে তাতে বিচিত্র কি? দারোগা-পুলিশ এসে তাদের সে গতরটা নিয়ে টানাটানি করলে তাদের বৌ ছেলে নিয়ে কি করে বাঁচবে? সমস্যার কথা, মস্ত সমস্যার কথা। মনির আহমদ শান্তভাবে জবাব দিলোঃ
“চাচা, আঁরা থাকতে তোঁয়ার মতো বুড়ো মাইনষেরে পুলিশে কিয়রলায় ধরিব?” (চাচা, আমরা থাকতে আপনার মতো বুড়ো মানুষকে পুলিশ কি জন্য ধরবে?)
বুড়ো আশ্বস্ত হয়। তার ঠোঁটে হাসির একটা ক্ষীণ রেখা জেগে ধীরে ধীরে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
“কি যে ক’ বাজান। আঁর হাতপুতের জীবন থাকতে তোঁয়ারে কিয়লায় পুলিশে ধরিব? খাঁটি মানুষ চিনি বাজান, মাথার চুল বাতাসে ন পাকে। তুই আঁরার সোনা, আঁরার মানিক।” (কি যে বলো বাপ, আমার সাত ছেলের জীবন থাকতে পুলিশ তোমারে ধরবে কেন? খাঁটি মানুষ চিনি, মাথার চুল বাতাসে পাকে নি। তুমি আমাদের সোনা, আমাদের মানিক।)
আরো নানা পরামর্শ হয়। হাসিম দেখতে পায় সমবেত মানুষের মনোবলের ওপর নির্ভর করে একটা কর্মসূচী দাঁড় করাতে পেরেছে। আজ তার শিক্ষা হলো, নির্ভেজাল মন নিয়ে এগুতে পারলে জীবনে পরাজয় নেই। উদ্দেশ্য মহৎ থাকলে মানুষ একদিন না একদিন সাড়া দেবেই। তার মনে হলো অন্তর থেকে নীচতা, ক্ষুদ্রতা, দুর্বলতা হেমন্তের ঝরা পাতার মতো ঝরে যাচ্ছে। নিজের দুর্বলতার ভারে সব মানুষ পীড়িত। দুর্বলতাকে ঝেড়ে দিয়ে সবলে সজারুর মতো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে ক’জন? লক্ষ কোটি ভীরু নর-নারীর মধ্যে অমন বলিষ্ঠ মন ক’জনের?
মিটিং থেকে ফিরে এসে দেখে প্রসব-বেদনা উঠেছে সুফিয়ার। একটা প্রাণকে পৃথিবীতে আনার জন্য আরেকটা প্রাণের সে কি আকুলি-বিকুলি। সে কি বুকভাঙ্গা বেদনা। সৃষ্টি, হায় রে সৃষ্টি! এতই বেদনা সৃষ্টির। হাসিম কাকে ডাকে! সে কি জানে? তার ভয় করে। কি কঠিন পরীক্ষার ভেতর দিয়ে মানুষ পৃথিবীতে আসে! ভয় করে তার। থরথর করে কাঁপে। এখন কি করবে সে? কি করার আছে তার? কে আসবে নিদারুণ এ বিপদের সময়। সমিতির মানুষদেরকে ইচ্ছে করলে ডাকতে পারে। কিন্তু দরকার তার একজন মাত্র মানুষের, যে সুফিয়ার উদরস্থ সন্তানকে মুক্তি দিতে পারে। তেমন একজন কুশলী মানুষ তার চাই। সামনে প্রিয়তমা পত্নী নিজের চুল ছিঁড়ছে। পেটটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে উঠছে। শরীরখানা বার বার ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে। শরীরের অণু-পরমাণুতে ভূমিকম্পের কাঁপুনি, শরীরের অভ্যন্তরে কি হচ্ছে? কি হচ্ছে সে জানে না। বোধ হয় নাড়িভূড়ি তার ছিঁড়ে যাচ্ছে? অথচ হাসিম অসহায়! কতো অসহায় সে? কতত অসহায় মানুষ? নিজেকে বড় নিষ্ঠুর মনে হয়। সে-ই তো সুফিয়ার এ দুর্দশা ঘটিয়েছে। রাস্তায় ধুলোখেলা করতো মেয়েটি। চঞ্চল হরিণের মতো হেসে-খেলে বেড়াত। কালের জোয়ারে তার দেহে যৌবন নামলো। ফাঁপানো যৌবনের সমস্ত সম্ভারসহ তৃষ্ণার তাপে বন্দী হলো। সর্বগ্রাসী তৃষ্ণা, সর্বভূক ক্ষুধার উত্তাপে শরীরের ভেতর শরীর, মাংসের ভেতর মাংস, প্রাণের ভেতর প্রাণ জেগে উঠলো। সে প্রাণ এখন বন্দী কারার ভেতরে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছে। উদরের দেয়ালে ঘোষণা করে জানিয়ে দিচ্ছে, আমার বন্দীদশার মেয়াদ ফুরিয়েছে। আমি মুক্তি পেতে চাই, মুক্তি পেতে চাই আমি। কে কোথায় আছো, তোমরা আমাকে মুক্ত করে নাও।
সুফিয়ার সারা শরীর ধনুষ্টঙ্কারের রোগীর মতো বেঁকে যাচ্ছে। তার শরীরে তরঙ্গের পর তরঙ্গ ভাঙছে। মুখে ফেনা ফুটছে। কাকে ডাকবে? কে পারে টেনে আনতে প্রাণের ভেতর থেকে প্রাণ? কে পারে গর্ভস্থ সন্তানকে মুক্ত করে উদার আলোকে টেনে আনতে? কে? কে?
সুফিয়া এখন নিষ্ঠুর। তার মুখ দিয়ে গালাগালি ছুটছে। সে কাকুতি-মিনতি করছে, সজল তার চোখ। বুকে রক্তিম বেদনা। বেদনার ক্ষিপ্র আকর্ষণে হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে পড়তে চাচ্ছে। সে কিছু বোঝে না, এমনি বড় অবুঝ সে। তার বুকে বেদনা। মুক্তি চায়, ডেকে বলছে, না না, মুখ দিয়ে তার কথা বেরুচ্ছে না। কথা বলছে, সুফিয়ার হাত এখন মানুষের শিশু, মানুষের সংসারে এখন তার আসার সময়। কে কোথায় আছ, টেনে নিয়ে এসো। উদরের মাংসল আবেষ্টনীর অন্তরাল থেকে রক্ত মাংসের সন্তান বের করে নিয়ে এসো। জরায়ুর দ্বারে সবেগে আঘাত করছে। অন্ধ শিশু পথ খুঁজে পাচ্ছে না, নতুন অভিযাত্রী পথ চিনে না। তাকে তোমরা দক্ষ হাতে কপাট খুলে বরণ করে নাও।