অনেক মানুষ এসেছে। বলতে গেলে সকলেই পরিচিত। ভোরে উঠে এদের মুখ দেখে। তার মুখ এরা দেখে। এদের মুখ সে দেখে। সকলেই হাসিমের মতো খেটে খাওয়া মানুষ। কর্মীদের সকলেই গরীব। কারো এক-আধ কানি জমি আছে–কেউ ভাগচাষী। আবার অনেকে অপরের জমিতে মজুর খাটে। একসঙ্গে অতগুলো মানুষকে দেখে তার ভারী অনন্দ হয়। প্রত্যেকটা পরিচিত মুখকে সে বার বার খুঁটিয়ে দেখে। নিরাশ হলো হাসিম। সমবেত মানুষের চোখে-মুখে যে জিনিসটিকে দেখতে চেয়েছিলো তা কই? অভাব দুঃখ সয়েও জয় করতে হবে। জান যায় যাক। মৃত্যুর তেমন সরল প্রস্তুতি এদের কই? হাসিম অবাক হয়ে ভাবে, মানুষ মরতে ভয় পায় কেন? আদর্শের আগুন রক্তের ভেতর, বুকের ভেতর না থাকলে মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারে না, মৃত্যু, আমি তোমার চেয়ে অনেক অনেক বড়ো!
মনির আহমদ উঠে গুছিয়ে গুছিয়ে দাঁড়ানো লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলছে। লোকগুলো মোটেও কথা শুনছে না। শোরগোল করছে। চেঁচামেচি চেল্লাচেল্লি করছে। হাসিমের ভারী দুঃখ হয় মানুষটার জন্য। চোখে ঘুম নেই। পেটে ঠিকমতো ভাত পড়ে না। অথচ লোকটা তাদেরই কথা বলছে। হাসিম দেখলো, রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে কথা বন্ধ হয়ে গেলো। সমস্ত উঠোনে কারো মুখে রা নেই। এমনিভাবে আরেক দিন মানুষ স্তব্ধ হয়ে জাহেদ বকসুর বাড়ীতে তার গান শুনেছিলো। আজ মানুষ কানের দু’দরজা খুলে দিয়ে শুনছে। মনির আহমদ বেশ বলতে পারে গুছিয়ে গুছিয়ে। বেঁটেখাটো মানুষটা মন্ত্র জানে নাকি? গান নয়, বাজনা নয়, শুধু মুখের কথাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো অতোগুলো মানুষ। কি কথা বলছে মনির আহমদ? পুঁথির কথা? কেচ্ছা-কাহিনীরে কথা? মুসা-নবীর কেরামতির কথা? শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের কথা? সে-সব কিছু নয়। ধীরে ধীরে গুছিয়ে গুছিয়ে বলছেঃ
“এ গ্রামে অধিকাংশ মানুষের জমি দক্ষিণ বিলে। দক্ষিণ বিলের জমি চাষ করে তারা সারা বছর বেঁচে থাকে। বৌয়ের বায়না মিটায়। মসজিদে শিরনী দেয়। পীর মুর্শিদকে দাওয়াত করে খাওয়ায়। এক কথায় দক্ষিণ বিলে যদি চাষ না চলে তা হলে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের উপবাসে কাটাতে হবে। এখন সে দক্ষিণ বিলের জমিতে কোম্পানীর নজর পড়েছে। বিলের তাবৎ জমিন কোম্পানী একোয়ার করে নিয়েছে। সকলের ওপর নোটিশ এসেছে। আগামী মাসের বাইশ তারিখে চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে যার যার দলিল-পত্র দেখিয়ে কানি প্রতি আটশো টাকা করে দাম বুঝে আনতে হবে। কারো দলিল-পত্রে ভেজাল থাকলে এক পয়সাও পাবে না।”
একটু থামলো মনির আহমদ। সমবেত মানুষ তার প্রত্যেকটা কথা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনছে। তারপরে শুরু করলোঃ
“এ জমি এক কানির দাম তিন হাজার টাকারও বেশি। কোম্পানী দিতে চায় মাত্র আটশো টাকা। কোম্পানী ফ্যাক্টরি করে সিগারেট বানাবে। বেচে ডবল ডবল মুনাফা করবে। কিন্তু একশোটি পরিবার যে না খেয়ে মরবে তার কি হবে? আপনারা ছেলেমেয়েদেরকে কি খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবেন? নিজেরাও কি খেয়ে বাঁচবেন? বৌয়ের পিঠে কিভাবে কাপড় যোগাবেন? আজ টাকা পাবেন কাল খরচা হয়ে যাবে। নিজেদের দখল থেকে জমিটা চিরদিনের জন্য চলে গেলে কি করে বাঁচবেন?”
হাসিম দেখলো সমবেত মানুষের মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। চকমকির মতো প্রত্যেক কথার আঘাতে জনতার মুখ তেতে আগুন হয়ে যাচ্ছে। জাদু জানে নাকি মানুষটা?
মনির আহমদের কথা থামে না। বিনা উত্তেজনায় খুবই সহজভাবে তরতরিয়ে বলে যাচ্ছেঃ
“সিগারেট কোম্পানী ফ্যাক্টরি বানাতে চায় বানাক। পাহাড়ের দিকে বিস্তর খালি জমি পড়ে আছে। কোম্পানীর টাকা আছে ট্রাক্টর আনুক। পাহাড় ভেঙে ময়দান করে একটা কেন, একশোটা ফ্যাক্টরি করা যায়। আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এ বিলের জমি না হলে আমাদের চলবে না। বাঁচবো না আমরা। আট হাজার টাকাতেও এ জমি ছাড়বেন না। কেননা, এ জমি ছাড়া আমাদের অন্য কোনো নির্ভর নেই। কারো ব্যবসা নেই, চাকুরি নেই, অন্য কোথাও বাড়তি জমি নেই। যাদের এ বিলে কোনো স্বত্ব নেই, তাদের অনেকেও এ বিলের জমি ভাগে চাষ করে, মজুর খাটে। চাকুরি নওকরির টানে তারা কখনো বিদেশে যায় নি। বরগুইনির উর্বরা পলিতে কোম্পানীর নজর পড়েছে। সুতরাং গ্রামের মানুষ কি নির্বিবাদে সে জমি ছেড়ে দেবে? না, না। কিছুতেই তা হতে পারে না।”
“না, না,” কখনো না। এটা অত্যাচার। গরীবের ওপর অত্যাচার। এ অত্যাচারে কোম্পানীর সঙ্গে ইউনিয়নের মেম্বার-চেয়ারম্যান যোগ দিয়েছে। তাদের চোখের রাঙ্গা পুতুলীকে ভয় করে কি আমরা চুপ থাকবো? খলু মাতব্বরের দাঙ্গায় নিহত ছদুর মাকে মাতব্বর দুকানি সম্পত্তি দিয়ে আবার কেড়ে নিয়েছে। কাল আবার সে জমিতে হাল জুতেছে। দু’পক্ষের দাঙ্গায় অনেকেই আহত হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে। তাদের বৌ-ছেলেকে দেখছে কে? খলু মাতব্বর, জাহেদ বকসু, অধরবাবু, চেয়ারম্যান আফজল মিয়ার মতো মানুষ, যারা আপনাদের বারবার কেনা-বেচা করছে, তাদের বিশ্বাস করতে পারেন কি? এবারও তারা আপনাদের বিরুদ্ধে গিয়েছে। কোম্পানী তাদের টাকা দেবে। অনেক বেশি টাকা। অত টাকা জীবনে আপনারা কোনোদিন দেখেন নি। তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের দাবীর ওপর বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারবেন কি? আপনাদের একতার বল যদি অটুট থাকে কেউ জমিতে হাত বাড়াতে পারবে না। পারবেন কি আপনারা?”