জোহরা জবাব দেয় না। জবাবের ভাষা তার জানা নেই। সে কাঁদতে থাকে। তার চোখের পানির ফোঁটা দীর্ঘ হতে দীর্ঘতরো হয়। রোদে পুড়ে ঘামে ভিজে ঘরে ঢোকে হাসিম। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। জোহরা আঁচলে দু’চোখ মোছে। দু’চোখে ঝাপসা কুয়াশা।
“কি জোহরা কদর ক্যা?” (কি জোহরা, কাঁদছো কেন?) জিজ্ঞেস করে হাসিম।
জোহরা জবাব না দিয়ে চোখের রেখা দুটোকে বাইরের দিকে প্রসারিত করে দেয়। কাঞ্চনের ঠোঁট কাটা বৌটি আরো জোরালো গলায় বললোঃ
“চৌকের পানি ফেলাইলে কি অইব। কথাখান হাঁছা কি না হাসিমের সামনে ক।” (চোখের পানি ফেলে কি হবে। কথাটা সত্য কি না হাসিমের সামনে বলো।)
“কন্ কথা ভাবী?”।
“যেই কথাখান মাইনষে কই কই বেড়ার। জোহরার লগে দারোগার…।” (যে কথাটি লোকে বলে বেড়চ্ছ। দারোগার সঙ্গে জোহরার…।)
“অ যউকদে, অইসব কতা কইয়া লাভ নাই। এনে গল্প গরো।” (থাকগে, ওসব কথা বলে লাভ নেই। এমনিতে গল্প করো।)
কাঞ্চনের বৌ আর গল্প খুঁজে পায় না। পুরোনো প্রসঙ্গে একই কথা বারবার তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়। এ নির্লজ্জতায় হাসিম বেজায় বিরক্ত হয়। সে চায় না, তার চোখের সামনে জোহরা অতো বিশ্রীভাবে নাজেহাল হোক। কাঞ্চনের বৌ মুখ খুললে থামতে চায় না। ওটি তার দীর্ঘদিনের স্বভাব। পাড়ায় কাঞ্চনের বৌয়ের টাইটেল ব্যারিস্টার। পারতপক্ষে কেউ তাকে বিশেষ ঘটায় না। সুতরাং কণ্ঠস্বরও শোনালো বেশ তিরিক্ষি। ঝঙ্কার দিয়ে বললোঃ
“তোর ঘরত খাইবার লায়, পিন্দিবার লায় ত ন আই। আস্যি একখান কথা জানিবার লায়। কথাখান হাছান অইলে মাইনষে কই ক্যা বেড়ার? হলে বড় মাইনষের পিছ ধরে। হাসিম মিয়াও ধইরগে। কথা ত চাপান ন থাহে। ধর্মের ঢোল বাতাসে বাজে।” (তোর ঘরে খেতে-পরতে আসি নি। এসেছি একটা কথা জানতে। কথাটা সত্য না হলে লোকে বলে বেড়াচ্ছে কেন? সবাই বড় মানুষের পাশ ধরে। হাসিম মিয়াও বড় মানুষের পাশ ধরেছে। কথা তো চাপা থাকে না। ধর্মের ঢোল বাতাসে বাজে।)
কাঞ্চনের বৌ শক্ত মাটিতে পায়ের মুড়ি আছড়ে আছড়ে চলে গেলো। পায়ের রূপোর জলতরঙ্গ খাড়ু জোড়া ঝমঝম শব্দ করে। কোনো কিছু এখন গভীরভাবে চিন্তা করার সময় হাসিমের নয়। শহর থেকে কেরামত ভাইকে মনির আহমদ খবর দিয়ে আনিয়েছে। মিটিংয়ের পর মিটিং চলছে। আরো নানা রকম আলোচনা চলছে। হদিশ করতে পাছে না কোনো কিছুর। কিছুতেই গ্রামের মানুষদেরকে এক করা যাচ্ছে না। ওপরে দরখাস্ত করার নামে তারা ভয় পায়। একজন এগিয়ে এল তিনজন নানা অজুহাত দেখিয়ে পেছনে সরে যায়। ম্যাও ধরবে কে? সিগারেট কোম্পানী ধানি জমি একেবারে বিনি পয়সায় নিয়ে নিক। সারা বছর বৌ-ছেলে নিয়ে উপোস করতে রাজি। কিন্তু এ জমিটুকু গেলে অনেকের যে বাঁচবার উপায় থাকবে না। সুতরাং কিছুতেই তিন হাজার টাকা কানির জমি আটশো টাকায় ছেড়ে দেবে না। এমন কথা যে দরখাস্তে লেখা হয়েছে, তাতে টিপসই দিতে তাদের বড় আপত্তি। যদি দাবোগা, পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়, যদি হাজতে বছরের পর বছর বদ্ধ করে রাখে। জেলেও যেতে হবে না, একথা কেমন করে বলে? হাসিমের মাথায় সে-সব ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে। দুটো মুখে দিয়ে কাঁধে জামাটা ফেলে লম্বা কদমে চলে যায়। সুফিয়া প্রস্থানরত হাসিমকে উদ্দেশ্য করে স্বগতোক্তি করেঃ
“সমিতিতে রাজা-উজির বানাইব। রাইত নাই, দিন নাই আঁর দিন যে কেনে কাডে।” (সমিতিতে রাজা-উজির বানাবে। রাত নেই, দিন নেই, আমার যে কেমনে দিন কাটে।)
হাসিমের ওষ্ঠাধরে একটা শুষ্ক হাসি খেলে যায়। পাহাড়ে বাঁশ কেটে, কাঠ কেটে যে-লোক জীবন চালায় তার বৌয়ের দিন অন্য দশ কাঠুরের বৌয়ের মতোই কাটে। সমিতিতে সে রাজা-উজির বনার জন্য যায় নি। লোকগুলো সরল– তাকে গ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যে সহানুভূতি এবং সমবেদনামাখা প্রাণখানা দেখতে পেয়েছে। হাসিমের মতো অবজ্ঞেয় এবং উপেক্ষিত মানুষকেও তারা ভাই বলে গ্রহণ করেছে। তাই হাসিম যায়- হাসিমের মনখানা টানে। টাকা-পয়সা বিত্ত-বৈভবে মানুষের সত্যিকার পরিচয় ফোটে না। মানুষের পরিচয় অন্য কোনো কিছুতেই প্রকাশ পায়। লেখাপড়া তো কানা আফজলের বড় ছেলেটাও করেছে। অনেকগুলো পরীক্ষায় পাশ করেছে। অনেক টাকা মাইনে পায়। আমেরিকা না কোথাও ছিলো ক’বছর। ছুটিছাটার সময় বাড়িতে এলে মোটা চুরুটজ্বলা মুখখানা দেখে অমন ভয় পায় কেন হাসিম! অমন শিক্ষিত লেখাপড়া জানা মানুষেরও মানুষখেকো বাঘের চোখ কেন? দূর থেকে দেখলেও বুকের ভেতরটা কেন ভয়ে গুড়গুড় করে! সমাজের বিয়ে-শাদি, ঈদে-জামাতে, কোথাও সে সহজ অনুভব করে না কেন? সমিতিতে গেলে মনখানা ছাঁৎ করে কেন আসমানের মতো প্রসারিত হয়ে যায়। এর কারণ কি, অনেকবার ভেবে দেখেছে মনে মনে। সমিতির কোনো লোক ছোট চিন্তা করে না, স্বার্থের নামগন্ধও কারো কথায় নেই। সেজন্য বোধ হয় জীবনের সমস্যাগুলোকে অমন নিখুঁতভাবে তলিয়ে দেখতে পারে। তাদের ঐকান্তিক আগ্রহের মধ্যে, চিন্তার মধ্যে–এমনকি অক্ষমতার মধ্যেও এমন কিছু আছে যা অনেককে এক করে। সে জিনিসটা কি? আর কিছু নয়– সরলতা আর নিষ্ঠা। যা বলা তা বিশ্বাস করা, যা বিশ্বাস করা তা করা। কর্মীদের চোখে-মুখে সে বিশ্বাসকে অনেকবার জ্বলতে দেখেছে। তারও অমন জ্বলে নাকি? কেরামত ভাই সেটাকেই কি বলেন আদর্শ? নানা কথা চিন্তা করতে করতে সে পুব পাড়ার আহমদ মিয়ার বাড়িতে কখন এসে গেছে। পশ্চিম দিকে চেয়ে দেখে সূর্য অনেক ঢলেছে।