সকালে ঘুম থেকে উঠে গোয়াল সাফ করে। ঝুড়ি ভরে ছটা গরুর গোবর গাদায় ফেলে দিয়ে আসে। তারপরে চাচাত ভাইয়ের ছেলেটিকে নিয়ে আদর করে, ঘুম পাড়ায়, কচি শিশুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে দুঃখজ্বালা জুড়োতে চায়। রান্নাবান্নার কাজে, চাচাত ভায়ের বৌ দুটিকে সাহায্য করে। মাতব্বরের দু’বৌয়ের ফাইফরমাশ খাটে। একান্নবতী পরিবার। প্রত্যেকদিন ঝগড়া-ঝাটি লেগেই আছে। ছোট বিবি মাঝে মাঝে না খেয়ে রাগ করে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জাগিয়ে সেধে সেধে খাওয়াতে হয়। মেজ বৌ বাপের বাড়ি চলে যাবার ডর দেখায়। বড়ো ভাইয়ের বৌ অনুযোগ করেঃ
“এই এজিদার সংসারত পড়ি হাড্ডি-মাংস কালি অই গেল।” (এই এজিদের সংসারে পড়ে হাড়-মাংস কালি হয়ে গেলো।)
জোহরার শরীরে হাড়-মাংস নেই। আগুনও লাগে না, কালিও হয় না। কারণ তার যাওয়ার জায়গা নেই। যাবে সে কার কাছে? চাচার বিরাট সংসারে সকলের মন যুগিয়ে চলতে হয়। সকলে ব্যথা দেয়, আঘাত করে; কাউকে ফিরিয়ে সে আঘাত দিতে পারে না। আঘাতের মাত্রাটা ইদানীং তীব্রতরো হয়ে উঠেছে। আঘাত, নিরাশা আর দ্বন্দ্বের তাড়নায় তার হৃদয়টা ভেঙে শত টুকরো হয়ে গেছে। আর সইতে পারছে না সে। উষ্ণ নিঃশ্বাস বুকের ভেতরে জমে জমে উত্তপ্ত বাষ্পের সৃষ্টি হয়েছে। আগে মানিয়ে নিতে সকলের সঙ্গে। সকলের খুশির অনুপাতে নিজেকে ছোট করে নেয়ার শিক্ষা তার আজন্মের। দারোগার কাছে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার পর সে উৎসাহ তার মরে গেছে। কাজকর্মে প্রেরণা পায় না। চাচীরা খুব কষে গালাগাল দিলে ড্যাবড্যাবে কালো দু’চোখ মেলে চেয়ে থাকে। কি জবাব দেবে ভেবে পায় না।
মাতব্বরেরা মামলা নিষ্পত্তি করার জন্যে শহরে গেছে। পুরুষ মানুষ কেউ ঘরে নেই, তাই জোহরা সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে মুখ-হাতে পানি না দিয়ে ঘরের বারান্দায় মূর্তির মতো ধুম ধরে বসে রইলো। মেজ বৌ তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ
“গোয়াইল সাফ গইরগস নি?” (গোয়াল পরিষ্কার করেছ?)
“না,” নিস্পৃহ জবাব জোহরার।
“আইজো না?” (এখনো না?) ঝংকার দিয়ে ওঠে।
কোনো জবাব না দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসা মেজ বৌয়ের ছেলেটার দিকে হাত বাড়ালো। জোহরার প্রসারিত হাত থেকে ছেলেটাকে একরকম জোর করেই ছিনিয়ে নিয়ে গেলো বৌঃ।
“অইয়ে অইয়ে, আঁর পোয়ারে আর সোয়াগ দেখান লাইগত নয়। তোর প্রত্যেক নিয়াশত বিষ।” (হয়েছে, হয়েছে, আমার ছেলেকে আর সোহাগ দেখাতে হবে না। তোর প্রত্যেক নিশ্বাসে বিষ।)
ঘৃণা ভরা চোখ দুটো জোহরার দিকে মেলে ধরে। মেজ বৌ জোহরাকে ঘৃণা করে। তার প্রতি নিশ্বাসে বিষ। এ বিষে তার কচি ছেলের নরম শরীর জর্জরিত হতে পারে। সেজন্যে আপন ছেলেকে ডাকিনীর হাত থেকে কেড়ে নিলো। বড়ো ভাইয়ের বৌ বিশ্রী হাসে। সকলের আচরণ জোহরার চোখে গভীর ইঙ্গিতময় ঠেকে। সে গোবর ফেলার ঝুড়িটা নিয়ে গোয়ালে চলে যায়। তার বাপের আমলের বুড়ো বলদটার গলা জড়িয়ে কাঁদে। শিং দুটোতে হাত বুলোয়।
খাওয়া-দাওয়ার পর সুফিয়ার ওখানে যায়। আকাশে চড়চড়ে রোদ। দক্ষিণের সাগর থেকে শীতল শীতল হাওয়া আসছে। কিন্তু জোহরার শরীরে-মনে দাহ, প্রবল দাহ। মুক্তি পেতে চায় সে। কোথায় সোনার রোদ চলকানো সে মুক্তির মনোরম দিগন্ত?
আজকাল সুফিয়া বিশেষ কথা কয় না। সে ভারী হয়ে গেছে। তার শরীরের ভেতর শিশু সন্তান দিনে দিনে জীবনী-রস সংগ্রহ করে বেড়ে উঠছে। সুফিয়ার মনেও বেদনা। সৃষ্টির সে আদিম বেদনা। জন্ম দেয়ার, জন্ম নেয়ার বেদনা। জোহরার বেদনা সে আরেক রকম। দুজনের চোখের দৃষ্টিতে তা উদ্ঘাটিত। সেজন্য চিন্তার গতি দু’জনের দু’দিকে। সুফিয়ার পরিতৃপ্ত মুখমণ্ডলের দিকে চেয়ে জোহরার মনে বুঝি একটা বেদনার তীর্যক রেখা জাগে। তার যৌবন বারবার হাত বদলের মধ্যে থেঁতলে গেছে। হৃদয়ের পানকৌড়ি তৃষ্ণার সুকোমল কোরক সকল ঝরে গেছে। আপনার বলতে যা ছিলো, সে রাতে দলিত মথিত করে দিয়ে গেছে। সুফিয়া পেটে সন্তান ধারণ করেছে। সন্তান ধারিণীর কেমন লাগে, কেমন হয় অনুভূতি, জোহরার জানতে ইচ্ছে করে। সুফিয়ার কি খুব বেশি ভয় লাগে? তার চোখের ভেতরে জীবন্ত অতৃপ্তিকেই দেখতে পায় সুফিয়া। জোহরার চোখের দৃষ্টিতে অনেক অফলন্ত আশা, অনেক নিহত কামনাকেই ঝিলিক মারতে দেখলো। কেমন জানি সুফিয়ার ভয়।
কাঞ্চন মিয়ার বৌ সুফিয়াকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকে জোহরাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। কাঞ্চনের বৌয়ের চোখ দিয়ে অস্বচ্ছ একটা নীলাভ জিজ্ঞাসা ধূমায়িত হয়। পান-খাওয়া গ্যাটগাটে লাল দাঁতগুলো দেখা যায়। ঘরের নীরবতাকে ফালি ফালি করে কাটে কাঞ্চনের বৌয়ের কণ্ঠস্বরঃ।
“জোহরা, তুই আইস্যছ, ভালা অইয়ে, একখান কথা জানি লইয়ম।” (জোহরা তুই এসেছিস, ভালো হয়েছে, একটা কথা জেনে নেবো।)
“কি কথা ভাবী?” শুধোয় জোহরা।
“কি কথা ন জান না? কানত কি দিয়স? মাইনষে ছি ছি গরের। আইচ্ছা, কথাখান কি হাঁছা?” (কি কথা জানিস না? কানে কি দিয়েছিস? মানুষ ছি ছি করছে। আচ্ছা, কথাটা কি সত্যি?)।
“ওমা! গালে হাত দিয়ে কাঞ্চনের বৌ অবাক হয়ে যায়! হেই যে দারোগা আর তোর নামে যে কথা বাইর অইয়ে, ন হুনস আইজো?” (সেই দারোগা আর তোর নামে যে-কথা বের হয়েছে আজো শুনিস নি?)।