“কোয়াল্যা মানুষ।” (ভাগ্যবান মানুষ।)
“রফিক মিয়া কোয়াল্যা নইলে কোয়াল্যা কন? গাইডের টেয়া মোডেও খরচ ন অয়। সতের ভরি সোনা আন্যে মক্কাখুন। আর ঘড়ি অন্যান্য জিনিস যা আন্যে না, হাজার চেঁয়ার মতো লাভ অইয়ে।” (রফিক মিয়া ভাগ্যবান না হলে ভাগ্যবান কে? গাঁটের পয়সা মোটেই খরচ হয় নি। মক্কা থেকে সতের ভরি সোনা এনেছে। ঘড়ি আর অন্যান্য জিনিস যা এনেছে, তাতে করে হাজার টাকা লাভ হয়েছে।)
“আল্লায় যারে দেয়, আসমানখুন ঢালি দেয়।” (আল্লাহ্ যারে দেয় আসমান থেকে ঢেলে দেয়।) মন্তব্য করে জাহেদ বকসু।
সালুনের ভাত খাওয়ার পর দৈয়ের ভাত নিয়েছে পাতে মেহমানেরা। ধোপাছড়ী থেকে আগে বায়না দিয়ে মহিষের দৈ আনিয়েছে। হাঁড়ি ভাঙলেও দৈয়ের চাক ভাঙ্গে না। চাক চাক দৈ তুলে নিয়ে ভাতের সঙ্গে মাখছে। পানি দিয়ে মেঠো করে নিচ্ছে। ভাত। চিনি মাখছে ভাতে। এমন সময় রাতের বুকে তীব্র ছুরি হেনে জেগে উঠে ছদুর মা’র বুকভাঙা কান্না।
“অ-পুতরে!”
এ অভাবিত ক্রন্দনে তারা চকিত হয়। একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়। ভাতমাখা বন্ধ হয়ে গেছে। হারিয়ে ফেলেছে গল্পের সূত্র। কিছুক্ষণ পর আবার গেরাসে গেরাসে মুখে তুলে দেয়। মনের চিন্তাকে তারা ঢোক গিলে চাপা দিতে চায়। খলু হাত জোড় করে বলেঃ।
“বেয়াদবী মাপ গরিবান, কিছু খাবাইতে ন পাইরলাম, হুধা হাডাইলাম।” (বেয়াদবী মাফ করবেন। কিছু খাওয়াতে পারলাম না। শুধু শুধু হাঁটালাম।)
খাওয়া-দাওয়ার পরে তারা পরামর্শ করে। হাসিম শুনে। আগামীকাল কোর্টে গিয়ে সোজা দাখিল করবে। দারোগাকে টাকা দিয়ে ছদুর মা’র মামলার গোড়া কেটে দিতে হবে। দারোগা ফাইন্যাল রিপোর্ট দিলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। কাদির মিয়া চালাক। এতো সহজে দারোগা যে বশ হবে না বিলক্ষণ জানে। সে সন্দেহ করেঃ
“কিন্তু দারোগারে কেনে বশ গইরগম?” (কিন্তু দারোগাকে কেমন করে বশ করবে?)
“যেনে বশ অয়।” (যেমনিতে বশ হয়।) খলু জবাব দেয়।
“অনেক টেঁয়াত দেয়ন পড়িব।” (অনেক টাকা তো দিতে হবে।)
“হ টেঁয়া কিছু ন দিলে অইব কেনে?” হে কিছু টাকা না দিলে চলবে কেমন করে?)।
“সামান্য টেঁয়ায় ত কুলাইত নয়। অনেক কেঁয়া চাইবো।” (সামান্য টাকায় তো কুলোবে না। অনেক টাকা দাবী করবে।)।
“ক্যা, পাঁচশো দিত পাইরতা নয়?” (কেন পাঁচশো টাকা দিতে পারবে না?)
“না আঁর কাছে দেড় হাজার টাকা চাইয়ে।” (না, আমার কাছে দেড় হাজার টাকা দাবী করেছে।)।
“আরে না, আই পাঁচশো টেয়া দি মিটমাট গরি ফেলাইয়ম।” (আরে না, আমি পাঁচশো টাকা দিয়ে মিটমাট করে ফেলবো।)
“কেনে?” (কেমনে?)
“হেই ওষুধ জানি। চেয়ারম্যান সাবের থুন পুছ গড়ন।” (সে ঔষধ জানি। চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করুন।)।
কানা আফজল খলুর দিকে তাকায়। দুজনেরই চোখে চোখে ভাষা বিনিময় হয়। দু’জনেই হেসে ওঠে। টাকার সঙ্গে আরো একটি জিনিসের প্রতি যে গাঢ় আসক্তি দারোগার আছে, সে কথা খলু আর চোখের ঠারে জানায়। কানা আফজল তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলেঃ
“সাবাস খলু সাবাস, লেখাপড়া গইরলে তুই মন্ত্রী অতি।”
হাসিমের চোখের সামনে নির্মমভাবে ধর্ষিতা জোহরার ছবিটিই জেগে ওঠে। দু’দিন পরে সে তিন কানি জমিতে খলু কাদির মিয়া পাশাপাশি হাল জুতে। চৌধুরী পাড়ার লড়াইয়ের খেলায় যে ষাঁড়টাকে নিয়ে দাঙ্গা লেগেছিলো সে ষাঁড়টাকে হালে জুতেছে খলু কাদির মিয়াও তা’রটাকে। কেমন টগবগিয়ে হাঁটছে ঘাড় বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে। খলু কাদির মিয়াকে জিজ্ঞেস করেঃ
“কি ধান দিবা, মোড়া না চিয়ন?” তার মানে সরু ধান না মোটা ধান।
“চিয়ন ধান দিয়ম। মোডা ধানের ভাত কেউ ন খায়, গাউর জন ছাড়া।” (সরু ধান দেবো। মোটা ধানের ভাত কেউ খায় না, জন-মজুরেরা ছাড়া।)।
“তুই?” (খলু কি সরু না মোটা ধান দেবে জানতে চায়।)
“চিয়ন ধান দিয়ম। আঁরও একই দশা, চিয়ন ছাড়া ন খায় কেউ।” (সরু ধান দেবো। আমারও এক দশা। সরু ছাড়া কেউ খায় না।)
হাসিম সমিতির অফিস থেকে বিল কোণাকোণি পথে আসতে আসতে তাদের কথোপকথন শোনে। ছদুর রক্ত কি শুষে নিয়েছে কুলটা মাটি! হঠাৎ আলের ওদিকে কে একজন কথা কয়ে ওঠেঃ
“না না, আঁর মোড়া ধানের জমিন। চিয়ন ধান ন ফলে। চিয়ন ধান তোরা দিত পারতি নয়। আঁই চিয়ন ভাত খাইত ন পারি। খবরদার! খবরদার!” (না, না, আমার জমি মোটা ধানের। সরু ধান ফলে না। তোরা সরু ধান দিতে পারবি না। আমি সরু ভাত খেতে পারি না। খবরদার! খবরদার!)
কবীরের বাপের বুকের পাঁজরের হাড় ক’টি গোণা যায়। পিঠে বাঁকা চাঁদের মতো স্পষ্ট জেগে আছে গরুর শিংয়ের আঘাতের দাগটা। বুড়ো আসমানের দিকে চেয়ে ফরিয়াদ করেঃ
“আল্লাহ্, আঁর পুত কবীর মিয়া–আঁর বোবা পুত তিনকানি। তুই কড়ে নিলি?” (আল্লাহ্, আমার ছেলে কবীর মিয়া আর বোবা ছেলে তিনকানি–তুমি কোথায় নিয়ে গেলে?)
আসমানের আল্লাহ্ কোথায় নিয়েছে তার ছেলে কবীর এবং বোবা ছেলে জমি। ছেলের বাপ, জমির মালিক আকাশে তার অনুসন্ধান করছে।
৬. কথা গোপন থাকে না
কথা গোপন থাকে না। জোহরার সে কথাও পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেছে। শামুকের পেটে ভাত বেঁধে খেলেও আড়াই দিনে প্রচার হয়ে যায়। জগতের সকলে এখন বাঁকা চোখে জোহরার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘাটে পানি আনতে গেছে। অন্যান্য মেয়েরা কথা বলছে, তাকে দেখে সকলে চুপ করে গেলো। চমকে উঠলো, যেন দিনের বেলাতে ভূত দেখেছে। নীরবে পানি ভরে নিয়ে যায়। ভরা কলসীর পানিতে শব্দিত হয় তার বুকভরা দুঃখের ধ্বনি। পাড়ার লোক জোহরাকে দেখে বাঁকা হাসি হাসে, মন্তব্য করে, কথার ধারে চিরে যায় বুক। তবু জোহরা বাইরে শান্ত, অত্যন্ত শান্ত। কোনো ভাবান্তর নেই। নীরবে করে যায় সব কাজ।