সেদিনই সাঁঝের বেলায় কাজী পুকুর থেকে পানি ভরে নিয়ে যেতে দেখলো জোহরাকে। জোহরার চোখ-মুখ ঘিরে আছে বিষণ্ণতা-করুণ ম্লান। চেতনার গভীরে শেকড় প্রসারিত করেছে। তার চোখের কোণে কালি পড়েছে। চিন্তার কৃষ্ণ সরীসৃপেরা কুরে কুরে যাচ্ছে তার হৃদয়– সে কৃষ্ণবর্ণ হৃদয়ের ছবি সারা মুখে আভাসিত। বড় মায়া হয়, বড় দুঃখ জাগে হাসিমের। জোহরার অনেক দুঃখ, অনেক ব্যথা, অনেক ভাবনা। একপাশে কলসী কাখে সরে দাঁড়ায় তাকে দেখে। হাসিমকে কি যেন বলতে চায়। দু’চোখে কি একটা প্রশ্ন ফুটি ফুটি করেও ডুবে গেলো। বুকের ব্যথা কি চোখের দুটো মণিতে ঝিকিয়ে ওঠে? কি আবেদন জানাতে চায় জোহরা, বোব চোখের নীরব ভাষায়? হঠাৎ কেঁপে ওঠে মাটির কলসীটা হাতের বলয় থেকে খসে পড়ে ভেঙে যায়। বমি করতে চায়। কিন্তু বমিতে উগরানো যাবে না। গলার কাছে কি একটা বাধা। কিসের বাধা হাসিমের জানা। কিন্তু জোহরা কেমন করে সে কথাটি বলবে? পারে নাকি কোনো মেয়েমানুষ? যদি পারতো রক্তবমি করতো, আগুন বমি করতো সে?
জোহরা হতভাগিনী, তার হতভাগ্যের শেষ নেই। আগে দু’বার বিয়ে হয়েছিলে। চাচা খলু দু’বারই তাকে তালাক দিতে বাধ্য করেছে। কবীরের তিন কানি জমি বিরাট হাঁয়ের ভেতর পুরে দেয়ার জন্য কবীরকেও তালাক দিয়ে দিয়েছে। কবীর কি জোহরার শোকে মরেছে? জোহরার এখন কি আছে? সে জমিকে কেন্দ্র করে মারামারিতে অমন শক্ত-সবল মানুষটা প্রাণ হারালো। নারী হৃদয়ের সমস্ত কামনা সমস্ত বাসনার অংকুরটিকে চাচা খলু আর দারোগা মিলে পিষে ফেলেছে নির্মম হাতে। দু’দিন বাদে মাথায় নেমে আসবে কলঙ্কের ডালি। জোহরার থিরথিরানো কাঁপুনিতে সবকিছু হাসিমের চোখের সামনে জেগে ওঠে। মাত্র কিছুক্ষণ, যেন পেরিয়ে গেলো কয়েক যুগ। জোহরার ভবিষ্যতে কি আছে? কি করবে সে? এখন তার হৃদয় জুড়ে প্রকাণ্ড শূন্যতা। বৈশাখের ফুটিফাটা মাঠের মতো খা খা করছে। এ বিরাট শূন্যতাকে সে কি দিয়ে ভরাট করবে? কেউ কারো সঙ্গে একটি কথা না বলে চলে গেলো। কলসীর পানিতে সারা গা কাপড় ভিজে সপসপ করছে। গমনরতা জোহরার ভিজে কাপড়ে এক ধরনের শব্দ হয়। দুঃখের মুহূর্তেও অমন সুন্দর দেখায় কেন জোহরাকে?
সেদিন নবীর দোকানে শুনলে কাদির মিয়া আর খলুর মধ্যে আপোষ মীমাংসা হয়ে গেছে। মধ্যস্থতা করেছে কানা আফজল আর জাহেদ বকসু। তিন কানি জমিকে দু’জনে আধাআধি ভাগাভাগি করে ফেলেছে। এ আপোষে সকলে খুশি হয়েছে। ছদুর বাপ তো তসবীহ্ টিপতে টিপতে বললোঃ
“আপোষ বেহেস্তের নেয়ামত। রাগ চণ্ডাল। রাগ গরি এক মুসলমান আরেক মুসলমানের লগে কথা ন কইলে শুয়র অই কবরের থুন উডিব।”
কেউ কিছু বললো না। বেশির ভাগ মানুষের বুক চিরে কি একটা শব্দ বেরিয়ে নবীর দোকানের গুমোট আবহাওয়ায় মিশে গেলো। ছদুর বাপ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। দোকানের লোকগুলোর পাষাণ কঠিন নীরবতা তাকে থামাতে বাধ্য করলো। ছদুর বুকের রক্তে রাঙিয়ে যে-পথ বেঁধেছে সে পথেই তো এসেছে কাদির মিয়া আর খলুর মধ্যে সখ্য। মানুষের জীবন এতো সস্তা? হায় রে মানুষের জীবন।
দু’দিন পরে মাতব্বরের বাড়িতে বিরাটভাবে খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছে। পাড়ার লোকজনেরা খেতে এসেছে। খলু তার মা-বাপের নামে জেয়াফত দিচ্ছে। কথা রেখেছে মাতব্বর। জমি দখল করতে মদদ করলে তিন বেলা খাওয়াবে বলেছিলো। দখল পেয়েছে, তবে পুরো নয়। আধা আধা। সেজন্য তিন বেলার বদলে এক বেলা খাওয়াচ্ছে। তিনটা গরুর গোশতের বদলে হাটের গোশত খেয়ে গাঁয়ের লোকেদের সন্তুষ্ট থাকতে হলো।
কানা আফজল, জাহেদ বকসু এবং ইউনিয়নের আরো ভদ্রলোক এসেছে। সপ-সপের ওপর পাটি, তার ওপর সতরঞ্জি পেতে সম্মানিত মেহমানদের বসতে দিয়েছে। কাদির মিয়া, তার দু’ছেলে এবং সাতবাড়িয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের দু’জন মেম্বার এসেছে। মিহি গলায় কিসের যেন আলাপ করছে। যেন কতো জনমের বন্ধুত্ব। হাসিম কান পেতে তাদের আলাপ শুনে হতবাক হয়। কতো সহজে খলু মাতব্বর আর কাদির মিয়ার মিল হয়ে গেলো, ছদুর বুকের রক্ত তাদের মিলনের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। গলাগলি করে যেভাবে পূর্ণিমা বাসরের আলাপ করছে, তাতে মনে হয় সারাজীবন তাদের মধ্যে টু শব্দটিও হয় নি।
আর সকলে শুধু গোত আর তরকারী দিয়ে খেয়েছে। বিশিষ্ট মেহমানদের জন্য নানা রকম তরকারী পাক করা হয়েছে। সামনে চীনামাটির ফুল আঁকা পাত্রে সবকিছু থরে থরে সাজানো। পোলাও, গোশত, তরকারী আরো কত কিছু। পোলাও পাক করার জন্য খলু আলাদা বাবুর্চি এনেছে। ম ম ঘ্রাণ ছুটছে তরকারীর। তারা বিলম্বিত লয়ে আলাপ করছে। সুস্বাদু ব্যঞ্জনে চুলের মতো সরু দুধকমল চালের ভাত গেরাসে গেরাসে মুখে তুলে নিচ্ছে। ভাতের গেরাস চিবুতে চিবুতে কানা আফজল বললোঃ
“খাইলাম একবার জামির জুড়ির রফিক সওদাগরের বাড়িত তান মাইয়ার বিয়াত। যারে কয় খানা। মুখে এহনও লাগি রইয়ে।” (খেয়েছিলাম একবার জামির জুড়ির রফিক সওদাগরের বাড়ীতে, তার মেয়ের বিয়ের সময়। যারে কয় খানা। মুখে এখনো লেগে রয়েছে।)
“রফিক সওদাগর এইবার হজে গেইয়েল না?” (রফিক সওদাগর এবার হজ্জে গিয়েছিলেন?)
জানতে চাইলো কাদির মিয়া। কানা আফজল হাঁ-সূচক জবাব দেয়।