হাসিমের দিকে চোখ পড়াতে অধরবাবুর হাসি-হাসি মুখখানা গম্ভীর হয়ে যায়। কপালে স্পষ্ট ঘৃণার কুঞ্চিত রেখা জাগে। থু করে একদলা থুথু হাসিমের পানে ছুঁড়ে দেয়। তারপর জালের সংগে মাছটা জড়িয়ে চোখের কোণে তাকে বিদ্ধ করে বিলে নেমে হাঁক দিলোঃ
“আয়, গণেশ্যা চলি আয়।” (আয়, গণেশ চলে আয়।)
এতোক্ষণে হাসিমের চেতনা হয়। ছোটলোকের চাইতেও ছোটলোক সে। অধরবাবু মুখের ওপর থুথু ছুঁড়ে দিলো? একটা চাপা নিঃশ্বাস হাওয়ার শরীরে বিধে গেলো। ভাগ্য বিরূপ না হলে সেও এ পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরতে পারতো। বাপের ওপর তীব্র আক্রোশ জাগে। কি দরকার ছিল মুসলমান হওয়ার। অবশ্য শেষ বয়সে বুড়ো বলতো, ধন সম্পদ কিছুর লোভে নয়, শুধু বেহেস্তের খাতিরে আমি মুসলমান হয়েছি। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরটা বড়ো শুষ্ক; বড়ো করুণ শোনাতো। নিজের গলার স্বরে নিজেই চমকে উঠতো। নিজেকে যেমন পরকেও তেমনি লোকটা ফাঁকি দিয়েছে। হৃদয়ের সঙ্গে চিরটা জীবন কেবল মিথ্যা কথাই কয়ে গেলো। কোন বেহেস্তের মায়া! তা কি হাসিমের অজানা? কাজী সাহেবের মেয়েকে কি একটিবার পেয়েছিলো? তামাম জীবন এ পরিবারের দাসীর সঙ্গে ঘর করে মরতে হলো।
বাপের মৃত্যু-পাণ্ডুর বিবর্ণ-শ্লান মুখচ্ছবিটা মনে পরতেই মনটা তার নরম হয়ে এলো। অলিগলি করুণার রসে আর্দ্র হয়ে আসে। বাপের সীমাহীন বেদনা তার চেতনায় সঞ্চারিত হলো। বেলা পড়ে এলো লাকড়ির ভারটা আবার কাঁধে ফেলে বিলের মাঝ দিয়ে পায়ে পায়ে সৃষ্ট দূরের চিকন রেখা পথটা বেয়ে ঝিমে ঝিমে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। মাটির তাপ এখনো কমেনি। সূর্য নিঃশেষ হলেও কামানের ভাতির মতো জ্বলতে থাকবে।
উঠোনের কাঁঠাল গাছটার সঙ্গে লাকড়ির ভারটা হেলিয়ে রেখে ঝাঁপ খুলে ঘরের ভেতর ঢোকে। এক ছিলিম তামাক খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। কল্কির ঘেঁদাটা খুঁচিয়ে তামাক ভরে। আগুন তোলার হাতলওয়ালা মালাটা নিয়ে চুলোর ধারে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। আগুন নেই। একরাশ মরা ছাই। একটু উত্তাপও নেই। সুফিয়া কি তা হলে আজও রান্না-বান্না করে নি! ফোরম্যানের বউ একভার লাকড়ি নিয়েছিলো। আজ টাকা দেবার কাথা। টাকা দিলে চাল কিনে ভাত রান্না করতো। টাকা দেয়নি, রান্নাও চড়ে নি। তামাকের নেশা আর তার নেই। দু’হাতে মাথা ঢেকে চুলোর ধারে বসে পড়ে। ক্ষুধাটা দ্বিগুণ মালুম হয়। রান্না ঘরের হাঁড়ি-পাতিল তাকে দেখে যেনো বিদ্রূপ করছে।
এমনি সময়ে ঘরে ঢুকলো সুফিয়া। মুখখানা থমথমে, চোখ দুটো রক্তজবার মতো লাল। সে কঠিন মুখমন্ডলে আরো কঠিন ছাপ এঁকেছে উপবাস। হাসির অনুমান না করেও বুঝতে পারে, তার মতো সুফিয়াও সারাদিন কিছু খায় নি। নিজের অস্তিত্ব সুফিয়ার উদ্ধত দৃষ্টির সামনে কেমন সঙ্কুচিত হয়ে আসে। পাহাড়-পাথর কেটে যে মানুষ জীবন চালায়, তেমনি মানুষ হাসিম। তার কাঠিন্য সুফিয়ার দৃষ্টির তাপে কুপূরের মতো উড়ে যায়। এ বোবা অগ্নিফলার মতো দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে কি কথা বলতে হয়, হাসিম জানে না। উপবাস আর অভাবের যন্ত্রণার চইতেও এ এক তীব্র যন্ত্রণাময় হৃদয় খচখচ্ করা অনুভুতি। এ বোধ জন্মাবধি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে সুফিয়াকেঃ
“ফোরম্যানের বউয়ে টেঁয়া ন দ্যায়?” (ফোরম্যানের বউ কি টাকা দেয় নি?) সুফিয়া জবাব দেয় না। কঠিন মুখ তুলে লাল চেখের দৃষ্টি উচিয়ে ধরে। হাসিম সে চোখকে ডরায়। কেন জানে না। সুফিয়ার এ চোখ দেখলে তার মনে উথাল-পাথাল ঢেউ ভেঙে যায়। আবার জিজ্ঞেস করেঃ
“টেয়া ন দ্যায়?” (টাকা দেয় নি?)।
টাকার নামে সুফিয়া জ্বলে ওঠে। মেজাজে আগুন লেগে যায়। হাসিমের উদ্দেশে যা বলার নয়, তাই বলে ফেলে।
“টেয়ার নামে কাঁইচ কেলা দিব, নিষ্কর্মা মরদ, ভাত দিত ন পাইরলে বিয়া গইরত কনে কইয়ে?” (টাকার নামে কাঁচ কলা দেবে, নিষ্কর্মা মরদ, ভাত দিতে না পারলে কে বলেছে বিয়ে করতে?)
রাগের তোড়ে বাম হাতখানা হাসিমের মুখের কাছে এনে নানারকম ভঙ্গী সহকারে নানা অশ্লীল, অশালীন মন্তব্য করে। ফুটন্ত তেলে ছিটকার মতো এসে হাসিমের স্নায়ুতে আঘাত করে একেকটি কথা। ধারালো কাঁচের কুচির মতো হৃৎপিন্ড কেটে কেটে বসে যায়। ঠাস করে প্রবল হাতের একটা চড় দিয়ে বসে হাসিম সুফিয়ার মুখে। সুফিয়ার রক্তজবার মতো রক্তবর্ণ দু’চোখ ফেটে বেরোলো আগুন নয়, ঝরঝর চোখের পানির ধারা। সুফিয়া চড় খেয়ে ঘুরে পড়লো। উঠে সে আসমানের আল্লাকে ডেকে বললোঃ
“আল্লা, তুই আঁরে নে, এই দুনাই বিষ অই গেইয়ে।“ (আল্লা, তুমি আমাকে নাও, এই পৃথিবী আমার জন্য বিষ হয়ে গেছে।)
গরীবের ঘরে ঝগড়া–কাজিয়া এসব নতুন নয়। ঘরেতে অভাব, তাই ঝগড়া-কাজিয়ার সঙ্গেও করতে হয় ঘর।
হাসিম ঘরের বাইরে চলে আসে। সুফিয়া ঘরের দাওয়ায় পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে। অন্তরপোড়া দুঃখে অভিসিক্ত সে কান্নার সুর। আকাশ জুড়ে ধীর-মন্থর গতিতে সন্ধ্যা নামছে। আসমানে তারা ফুটছে। হাসিমের ঘর অন্ধকার।
উঠোনে বার হয়ে হাঁটতে থাকে হাসিম। পেটে ক্ষুধা আর হৃদয়ে অনুতাপ। হাঁটতে পারে না। মগজে চিককুত চিককুত ব্যথা। ভাবছিলো বটতলায় গিয়ে এক কাপ চা নবীর দোকান থেকে বাকীতে খেয়ে নেবে। চেনা-জানা দিলদার কেউ সামনে পড়লে এক আধসের চালও ধার চাইবে। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে নবীর দোকানেই চলে এলো। কিন্তু অবস্থা দেখে মুখটা তার শুকিয়ে এলো। শ্যামল বিশাল মুখমন্ডলে সন্ধ্যার চেয়েও গাঢ় হয়ে একটা কৃষ্ণছায়া নামে। আজ বাকী চাওয়া যাবে না। পয়সার জন্য জইল্যা চোরার সঙ্গে ঝগড়া করছে নবী।