ছদুর মা ধীরে ধীরে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। অভ্যেসবশে মাথার ঘোমটা টেনে দেয়। তার চোখের ভেতর বিরাট শূন্যতা। কানা আফজলের মতো ধড়িবাজ মানুষও সেদিকে চেয়ে থতোমতো খেয়ে গেলো। সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত আলো সে চোখ দুটোতে পুরে দিলেও শূন্যতা পূরণ হবে না।
“ছদুর মা, বিধির হুকুম ত কেউ খাইতে ন পারে। অহন উঁই এককেনা ঠাণ্ডা ন অইলে ত কতা কইতে ন পারি।” (ছদুর মা, বিধির হুকুম তো কেউ খণ্ডাতে পারে না, এখন তুমি একটু ঠাণ্ডা না হলে কথা তো বলতে পারবো না।)
“ভাইরে আঁর বুকত অইন।” (ভাই আমার বুকে আগুন।) ডুকরে কেঁদে ওঠে ছদুর মা। জাহেদ বকসু উঠে মুখটা মুছিয়ে দেয়। হাজার চেষ্টা করেও শান্ত করতে পারছে না। মৃগী রোগীর মতো হাত-পা ছুঁড়ছে। এবার কানা আফজল বলেঃ
“ছদুর মা, খলু তোঁয়ার ভরণ-পোষণের লায় রাস্তার পাশেই দু’কানি জমিন দিল।” (ছদুর মা, তোমার ভরণ-পোষণের জন্য খলু তোমাকে রাস্তার পাশে দু’কানি জমি দিলো।)
“জমি দি আঁই কি গইরগম রে ভাই। কনে চাষ গরিব? একবার চৌকের দেখা ন দেখিলাম পুতরে। বন্দার আশা পুরাইয়ে।” (জমিন নিয়ে আমি কি করবো ভাই। চাষ করবে কে? একবার ছেলেকে চোখের দেখা দেখলাম না। মানুষের আশা পূর্ণ হয়েছে।) “আল্লাহরে’ বলে চীৎকার ছেড়ে কেঁদে ওঠে।
কানা আফজল বিরক্ত হয়ে দু’কানের ভিতর আঙ্গুল পুরে দেয়। কান্নাকাটি শোনার মেজাজ নয় তার। গ্রামের চেয়ারম্যানের কথায় কান দেয় না, কেমন বেহায়া মেয়েমানুষ?
“ঠিক আছে, কথা অইল, দুই কানি জমি তোঁয়ারে দিল খলু। আঁরা সাক্ষী রইলাম।” (ঠিক আছে, কথা হলো, দু’কানি জমি তোমাকে খলু দিয়ে দিলো। আমরা সাক্ষী রইলাম।)
তারা উঠে পড়ে। ছদুর বউ উঠোনের এক পাশে ডালিম গাছের তলায় এসে দাঁড়ায়। জমিনের কোনো দরকার নেই। কি করবে সে জমি দিয়ে? কে একজন বললোঃ
“ছদুর বৌ–বৌয়ের কি হবে?”
“ছদুর বৌয়ের যুদি আপত্তি ন থাহে আঁর আনুর লগে শাদী দিয়ম। কেন অইব ক তোঁয়ারা দশজনে।” (ছদুর বৌয়ের যদি আপত্তি না থাকে আমার আনুর সঙ্গে বিয়ে দেবো। কেমন হবে বলো তোমরা দশজনে।) জবাব দিলো খলু। সকলে সায় দিলো।
“ভালা–খুব ভালা অইবো।” (ভালো, খুব ভালো হবে।) ওরা চলে গেলো। অনেক কাজ তাদের। এবার চন্দ্রকান্ত মুখ খোলেঃ
“কেন ভাইপুত, তোরে আগে কি কইলাম। বুঝিলি ছদুর জানের দাম মোডে দুই কানি জমিন না? আজিয়া দিব কালিয়া কাড়ি লৈব। বদমাইশ পোয়ারে আগে এত চেষ্টা গরিও বিয়া গরাইত না পারে। অহন এউগ্গা তৈয়ারী বউ পাই গেল। কেন ভাইপুত রাধামাধবের লীলা ‘তেল্যা মাথায় তেল। আতেল্যা মাথা ফুয়াই গেল। আল্লাহ্ ত খল্যা আর কানা আফজল্যার, কি কস?” (কেমন ভাইপো, আগে কি বলেছিলাম? বুঝলি ছদুর জানের দাম মোটে দু’কানি জমিন। আজ দেবে কাল কেড়ে নেবে। বদমায়েশ ছেলেটাকে আগে এতো চেষ্টা করেও বিয়ে করাতে পারে নি। এখন একটা তৈরি বৌ পেয়ে গেলো। রাধামাধবের কেমন লীলা ভাইপো দেখো। তেলা মাথায় তেল। আল্লাহ তো খলু আর কানা আফজলের, তুমি কি বল?)।
হ্যাঁ, আল্লাহ্ খলু আর কানা আফজলের। হাসিম কথা কয় না। মনে মনে আল্লাহ্র কেমন বিচার উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে। আল্লাহ্ তাদের না হলে অন্যের সর্বনাশ করেও কেমন করে তারা লাভবান হয়! আজ দু’কানি জমি মুখে মুখে দিলো। কাল কেড়ে নিয়ে যাবে। আনুর সঙ্গে খাদিম আলীর মেয়ের বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো দু’বছর আগে। অনেক ভেট বেগার বয়েও কোনো ফল হয় নি। ভেট বেগারে খাদিম আলীর মন ওঠে নি। সরল মানুষ খাদিম আলী। শত অনুরোধে খলু মাতব্বরের মতো পেঁচী মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ পাতাতে রাজী হয় নি। খাই খাসলত ভালো দেখে ছদুকেই মেয়ে বিয়ে দিয়েছিলো। ছদু গেছে, বউটা অল্প বয়সে রাড়ী হয়েছে। এখন খলু মাতব্বরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হতে খাদিম আলীর তরফ থেকে কোনো আপত্তি ওঠার কথা নয়। কেমন জটিল আর ঘোরালো আল্লাহর কল। সে কলে গরীবেরাই বা কেন পিষে যায়! চন্দ্রকান্ত নয় শুধু, গ্রামের সকলের মনে এ কথা লেগেছে। কিন্তু মুখ দিয়ে বের করার সাহস নেই কারো। বুকের কথা মুখে বলতে পারে না কেন মানুষ? কেন মানুষ মুখ ফুটে অত্যাচারকে বলতে পারে না অত্যাচার? এ সকল মৌলিক প্রশ্ন হাসিমকে ভয়ানকভাবে খোঁচায়। একজন দু’জন করে মেয়ে পুরুষ চলে যেতে থাকে। তাদের দৈনন্দিন কাজ আছে। যা হবার হয়ে গেছে। চন্দ্রকান্ত আর হাসিমও চলে আসে।
কিছুদিন পর শুনতে পেলো কানা আফজল আর জাহেদ বকসু খুব ঘন ঘন সাতবাড়িয়া যাওয়া-আসা করছে। খবর শুনে চট করে আনুমান করে নিতে আসুবিধে হয় না হাসিমের। খলু এবারও কোনো নতুন চাল চেলেছে। একদিন বাগিচার হাট থেকে আসবার সময় দেখতে পেলো খাঁর দীঘির উঁচু পাড়ে মিলিটারী বটগাছ তলায় বসে কানা আফজল, খলু, জাহেদ বকসু এবং কাদির মিয়া চুপি চুপি আলাপ করছে। দেড়মাস আগে দাঙ্গা করেছে খলু আর কাদির মিয়া। দাঙ্গায় একজন মানুষ প্রাণ দিয়েছে। ছদুর মতো অমন একজন মানুষের প্রাণ। এখনো চরের মাটি সে রক্তের সবটা শুষে নিতে পারে নি। এখনো প্রতিদিন বালুচরে সূর্যালোকে ঝিলিমিলি যা জ্বলে সে কি ছদুর রক্ত নয়? ছদুর মা’র কাঁচা শোক এখনো পুরোনো হয় নি। এরি মধ্যে খলুর সঙ্গে কাদির মিয়ার আপোষ হয়ে গেলো কেমন করে? তিন বছরের শত্রুতা কোথায় গেলো? এ কেমন করে সম্ভব? কেরামত ভাইয়ের কথা মনে পড়ে হাসিমের। কেরামত ভাই বলে, পূর্ণিমায় চোরেরা যতো ঝগড়া, যতো মারামারি করুক না কেন, অমাবস্যার জোতে সকলে একজাত। মহিষের শিং হানতে সোজা। তেমনি দুনিয়ার অত্যাচারীরা একজাত।