সুফিয়ার ডান হাতখানা বিশাল হাতের ভেতর পুরে আদর করে। আদরের স্রোতে সুফিয়া ভেসে যেতে চায়। আবছা একখানা স্বপ্ন আসে চোখে কেঁপে কেঁপে। সে যেন উজানী নায়ের মতো স্রোত কেটে কেটে ভেসে যাচ্ছে। দৃষ্টির অতীত হয়ে যাচ্ছে; দু’পাশের ঘরবাড়ি লোকালয়। উপরে উদার নীল আকাশ। একটু আগে সূর্য ডুবেছে। সিঁদুরের মতো বরণ ধরেছে আকাশ। একটি তারার ঝিকিমিকি। তারা আলোর দিকে চেয়ে চেয়ে দূরে বহুদূরে ভেসে যাচ্ছে। সামনে সাগর… অথৈ নীল জল নোনা পানির ঢেউ। ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে জ্বলে উঠছে শুভ্র শাদা চূর্ণিত ফেনার পুঞ্জ। জ্বলজ্বল করছে। একি, কোথায় যাচ্ছে সে? আতঙ্কে শিউরে ওঠে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার ছেড়ে ওঠেঃ
“আই ভাসি গেলামগই।“ (আমি ভেসে গেলাম)।
“কি?”
“আই ভাসি যাইরদে। আঁর ডর লাগেরদে।” (আমি ভেসে যাচ্ছি। আমার ভয় লাগছে।) আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর সুফিয়ার।
“কিয়র ডর আঁই ত আছি।” (কিসের ভয়, আমি তো আছি।)
অভয় দেয় হাসিম।
“তুই ত আছ, তারপরও ডর লাগেরদে।” (তুমি আছ তা হলেও ভয় লাগে।)
হাসিমকে জড়িয়ে ধরে কচি কলার ডগার মতো থিরথিরিয়ে কাঁপে। হাসিম তলপেটে হাত বুলিয়ে দেয়। ওখানে তার বীর্যের ব্যঞ্জনা শিল্পীর স্বপ্নের মতো ঘুমিয়ে আছে। সুফিয়া আশ্বস্ত হতে পারে না। অধিকতরো আতঙ্ক মেশানো স্বরে বললোঃ
“আই বাঁইচতাম নয় এবার।” (এবার আমি বাঁচবো না।) চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। হাসিম তার চোখের পানি সযত্নে মুছিয়ে দেয়। এ জল চোখের নয় হৃদয়ের।
“এইবার পইলা কিনা, হিথার লায় ডর লাগেরদে। কিছু অইত নয়, ডরের কিছু নাই।” (এবার পয়লা কিনা, সেজন্য ভয় লাগছে। কিছু হবে না, ডরের কিছু নেই।)
“নয়, নয় বুইঝতা নয়। আঁই আর বাঁইচতাম নয়। এতোদিনে আঁর আয়ু শেষ অইল।” (না, না, তুমি বুঝবে না। আমি আর বাঁচবো না। এতোদিনে আমার আয়ু শেষ হলো।)
ওদিকের আম গাছে একটা ভূতুম ভূতুরে স্বরে ডাকছে। হাসিম সুফিয়ার মুখ চেপে ধরে। অলক্ষুণে কথা বলতে দেয় না। ভূতুমটা অলক্ষুণে ডাক ডাকছে। না, না মরতে দিতে পারে না সে সুফিয়াকে। মা-বাপ, ভাই-বন্ধু কেউ নেই–আছে সুফিয়া, মায়ের মতো স্নেহে তাকে আগলে আছে। সে যদি মারা যায় কার কাছে যাবে হাসিম? বিশ্বভুবনে প্রাণভরা আদর দিয়ে আপন করে নেবে অমন কেউ আছে নাকি তার? ছোটোলোকের চাইতেও ছোটলোক হাসিম। যদি সুফিয়া মরে যায়! সন্তান প্রসব করতে গিয়ে অমন অনেকেই তো মারা যায়। মনের পরিস্কার আকাশে একখণ্ড কৃষ্ণবর্ণ মেঘের সঞ্চার হয়। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে… ছায়া বিস্তার করে। হাসিম ভাবে সুফিয়া মৌরলা মাছের ঝোল খেতে চেয়েছিলো। আগামীকাল মৌরলা মাছ ধরার কথা চিন্তা করে। মৌরলা মাছের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খারাপ খারাপ স্বপ্ন দেখলো। কখন দেখলো রক্ত, কখন আগুন, কখন রেলগাড়ি, মেয়েমানুষ আরো অনেক কিছু। এলোমেলো জড়ানো ছড়ানো পক্ষাঘাত জর্জর স্বপ্নরেখা মনের অবচেতনে সমুদ্রের কাঁকড়ার মতো হেঁটে গেলো।
পরদিন সকালে ছদুর মার বুকভাঙা চিৎকারে হাসিমের ঘুম ভাঙলো। এ সেই চীৎকার যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মৃত্যু, রক্তপাত আর সবকিছু হারানোর সুতীক্ষ্ণ হা হুতাশ। হাসিমের বুকটা চি চি করে। হাতে-মুখে পানি দিয়ে ছদুর উঠোনে এসে দাঁড়ায়। পাড়ার মেয়ে-পুরুষ সকলে এসে দাঁড়িয়েছে। ছদুর মা বুক চাপড়িয়ে কাঁদছে। সকলে তার দিকে চেয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না। বলবার কিইবা আছে? তার একটা ছেলে ছিলো। গ্রামের মান-ইজ্জতের প্রশ্নে যার শিরার রক্ত উজানে যেতো। তার শিরার শেষটুকু রক্ত চরের রেতী বালুতে ঢেলে দিয়ে গ্রামের মুখ রক্ষা করেছে। তাতে কার কি-ই বা বলার আছে?
এমন সময় কানা আফজল, জাহেদ বকসু আর খলু মাতব্বর উঠোনে এসে ঢুকলো। পুরুষেরা সসম্ভ্রমে উলে দাঁড়ালো। মেয়েরা এক হাতে গোমটা টেনে সরে দাঁড়ায়। সুপুরী গাছটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো হাসিম। একটু পরেই চন্দ্রকান্ত এসে হাসিমের পাশে দাঁড়ালো।
“ভাইপুত, দেখিস, এককান জানের দাম ক’ পয়সা দে।” কথা বললো চন্দ্রকান্ত। হাসিম জবাব দেয় না। শাদা পরিষ্কার কাপড় পরা মানুষগুলোর দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে দেখে। কানা আফজলের দিকে তাকায়। আধকালো আধপাকা দাড়িতে জড়িয়ে আছে বীভৎসতা। বুক চাপরাচ্ছে ছদুর মা। বৌটা বসে আছে ঘরের বাইরে। গতরাতে যে মেয়েটা দলিতা ফণিনীর মতো ছুটে গিয়েছিলো আজ দিনের আলোকে তাকে বড় নিষ্প্রভ, বড় স্নান দেখাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে জেগে ওঠা সুতীব্র প্রতিহিংসার তরঙ্গ কি রাতের অন্ধকারেই বিলীন হয়ে গেলো? অধোমুখে বসে আছে ছদুর বৌ। কলা গাছের আড়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার চুপসে যাওয়া মুখমণ্ডল। হাসিমের কেমন গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। চন্দ্রকান্ত কাঁধের ওপর হাত রেখে উচ্চারণ করলোঃ
“জয় রাধামাধব।”
কণ্ঠস্বরে আগের সে কৌতুকবোধ নেই। একযোগে চেয়ে থাকে দু’জন। কানা আফজল, জাহেদ বকসু ও খলু মাতব্বর ঘরের বারান্দায় একটা সপের ওপর বসেছে। কানা আফজল চোখের চশমা খুলে পাশে রেখে ডাকলোঃ
“অ ছদুর মা কথা হুন। এককেনা ঠাণ্ডা অও। আল্লাহ্র হুকুমের উয়র ত বান্দার হাত নাই। যা অইবার অই গেইয়ে।” (অ ছদুর মা, কথা শোন। একটু ঠাণ্ডা হও। আল্লাহর হুকুমের উপর তো মানুষের কোনো হাত নেই। যা হবার তো হয়ে গিয়েছে।)।