তারপরে দেখলো হাসিম। চোখের পানি মুছে ফেললো বউটি। পড়নের কাপড়খানা আঁটসাট করে পড়লো। বাহ্যজ্ঞানরহিত যেন স্বপ্নের মধ্যেই করে যাচ্ছে সব কিছু। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সকলে একদৃষ্টে ছদুর বউকে দেখছে। চুলের খোঁপাটা এলো হয়ে পিঠের ওপরে এলিয়ে পড়েছে। এলোচুলে ঘরের ভেতরে ঢুকে সাড়ে তিন হাতি কিরীচখানা নিয়ে এলো। এখনো ফলায় চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। এ কিরীচ নিয়েই ছদু দাঙ্গাতে গিয়েছিলো। কাদির মিয়াকে কোপ দিয়েছিলো। গাছের ডালে না লাগলে দুফাঁক হয়ে যেতো। তারপর কিরীচ রেখে বর্শা হাতে ছুটে গিয়ে কাদির মিয়ার বড় ছেলের উরু এক ঘাইয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলেছিলো। তার পরেও লড়াই দেয়া ষাঁড়ের মতো ছুটে গিয়েছিলো সাতবাড়িয়ার মানুষদের পিছু পিছু। সেই যে গিয়েছে ছদু আর ঘরে আসে নি। মর্মান্তিকভাবে আহত হয়ে থানা হাসপাতালে–থানা থেকে সদর হাসপাতালে–সদর হাসপাতাল থেকে একদম জীবনের ওপারে।
ছদুর কচি বউটির শোক কঠিন হয়ে জেগে উঠেছে। শঙ্খের চরের মেয়ে খেপা শঙ্খিনীর মতো ফনা তুলছে। ছুটছে সে ছুটছে, ছুটছে কিরীচ হাতে। শঙ্খের বানের জলের মতো গতি। খলুকে খুন করে জুড়োবে নাকি বুকের জ্বালা! বিশ্ব-সংসারের কারো এমন সাধ্য নেই যে প্রতিশোধ-পাগল এ হাল্কা পাতলা মেয়েটিকে ধরে রাখে। অন্ধ হয়ে অন্ধকারে ছুটেছে। হাতের ঝকঝকে রক্তপিপাসু তলোয়ার পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার হাতের অস্ত্র পথ চিনে। অন্ধকারে বারণ মানে না। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে সকলে। অজ্ঞান হয়ে হাঁটার সময় অন্ধকারে পিটুলী গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ‘মা রে’ বলে চীকার ছেড়ে কাদা মাটিতে ধপ করে পড়ে গেলো। হাত থেকে কিরীচ খসে পড়লো। ছদুর বউ নড়ে না, চড়ে না, ছদুর বউয়ের হুঁশ নেই।
বুকে একরাশ তরতাজা জ্বালা নিয়েই হাসিম ঘরে ফিরলো। প্রায় পনেরো দিন পর সে ঘরে ফিরছে। দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। পা দুটো ছড়িয়ে বসে সুফিয়া। স্ফীত উদরের জন্য পা দুটো ভিরিয়ে বসতে পারে না। পাশে বসে আছে জোহরা। চেরাগের আলোতে তার মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে। দু’চোখের কোণায় দুটো ভরভর পানির ফোঁটা টলমল করছে। অপরূপ সুন্দর লাগলো। মুছে গেলো রক্তের দাগ মন থেকে। মানুষের কান্নাও কি সুন্দর হতে পারে? কান্নাতেও কি হৃদয়ের রঙ ছায়া ফেলে? হাসিম গলা খাকারী দেয়। এস্তা হরিণীর মতো জোহরা ছুটে পালায়। কেন আসে? কেন ছুটে যায়? বাঁশের ঝাঁপটা টেনে ঢোকে। সুফিয়া হাসিমকে দেখে খুশি হয়–খুবই খুশি হয়।
সুফিয়াকে নতুন লাগে। তার গায়ের রঙে সজীবতা আসছে দিনের পর দিন। লেগে থাকে হাসিমের চোখ। ফিরিয়ে নিতে পারে না। অমনভাবে একা ফেলে যাওয়া উচিত হয় নি তার। কে আছে যে সুফিয়াকে দেখবে? প্রাণের ভেতর প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। গর্ভবতী মেয়ের প্রাণ কতো কিছুর জন্য ছটফট করে। কতো কিছু খেতে চায়। একটু আদর পাওয়ার জন্যে মনটা কেমন আইঢাই করে। মা নেই, বাপ নেই, কেউ নেই। আছে হাসিম। হাসিমও বাউলের মতো ঘুরে বেড়ায় দেশে দেশে।
সুফিয়া ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে হাসিমকে রাধা ভাত বেড়ে খেতে দেয়। নড়তে চড়তে তার কষ্ট হচ্ছে। একটা প্রাণকে পৃথিবীতে আনা সে কি সহজ কথা? শুয়ে পড়ে। শুয়ে আছালি-পিছালি করে। সুফিয়ার হাতে তৈরি আমের আচারের কাজী আর সুটকীর ভর্তা অমৃতের মতো লাগে।
খাওয়ার পর হাসিমও সুফিয়ার পাশে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। চুলে কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। একেবারে বুকের কাছটিতে এগিয়ে আসে সুফিয়া। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে কাদার মতো লেপ্টে থাকে। পাঁচ বছরের মেয়ের মতো মনে হয়। হাসিম তার গায়ে আর তলপেটে হাত বুলোয়। হাতের স্পর্শে সুফিয়ার শরীরে মিহি গভীর শিরশিরানি অনুভব করে। শিরায় শিরশির ফোঁটা যে আনন্দ তার কোনো প্রকাশের ভাষা নেই। একখানা হাত হাসিমের গায়ের ওপর চড়িয়ে দেয়। হাসিম সুপুষ্ট দু’বুক চেপে চেপে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে চেষ্টা করে। কিসের ঘ্রাণ সে জানে না। বাঁশের ফোকড় ফোকড় দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, আস্তে আস্তে শিরীষ গাছের উঁচু ডালটির আড়াল দিয়ে মেঘের বুক চিরে একফালি চাঁদ উঠেছে। গভীর রাতের ভেতর বুকের যেসব অতি গভীর কথা ভাষা পায় না… সে সকল কথাই যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়েছে চাঁদের আলোতে।
পাশে শায়িতা সুফিয়ার মুখখানা আবার ভালো করে দেখে। মন্দিরের প্রতিমার মতো নির্বাক নিটোল সৌন্দর্যময় মুখচ্ছবি। অতি সন্তর্পণে যেন উদরস্থ সন্তানকেও ফাঁকি দিয়ে একটা চুমু খায় মুখে। সুফিয়া তার হাত দুটোতে হাত বুলিয়ে নিয়ে যায়। সারা শরীরে তার হাত ঘোরাফেরা করে। সাপের গায়ের মতো শীতল গা সুফিয়ার। স্পর্শে জানাজানির বিদ্যুৎ সারাশরীরে ছড়িয়ে যায়। কোনো তুলনা নেই তার। প্রতিটি মুহূর্ত জমে জমে শিশির হয়ে যাচ্ছে। ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, যেন একেকটি মুহূর্ত গামছা দিয়ে বেঁধে রাখা যায়। যেন তারা অনেকদিন এমনি পাশপাশি শুয়ে আছে জন্ম জন্ম ধরে যেন শুয়ে আছে।
হাসিমের মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ির ওপর হাতখানা বুলিয়ে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করেঃ।
“কি চিন্তা গরদদে?” (কি চিন্তা করছো?)
“কিচ্ছু না।” আয়েশে হাই তুলে হাসিম।