“বাপজান, কেন কাঁদছি তোমাকে বোঝাতে পারবো না।”
মানুষ কেন কাঁদে তা কি বোঝাবার? তবু হাসিমের দরদী মন বুঝতে চেয়েছিল। জবাবে বুড়ী বলেছিলো। তার অনেক কথা মনে পড়েছে। ঘর-বাড়ির কথা… আত্নীয়-স্বজনদের কথা… আরো বলতে পারা যায় না এমন অনেক কথা… গভীর কথা মনে পড়েছে। তাই বুড়ী কাঁদছে। একটি মাত্র আশার অঙ্কুর শিশুসন্তানটি, তাও ঝরে যেতে বসেছিলো। বেঁচে উঠেছে হাসিমদের কল্যাণে। জিজ্ঞেস করলোঃ
“পোয়ার বাপ কডে, খালা?” (ছেলের বাপ কোথায়, খালা?)
“আর কোথায় যাবে, সকলে সবশেষে যেখানে যায় সেখানেই গেছে।”
“কি রোগ অইয়েলদে, খালা?” (কি রোগ হয়েছিলো খালা?)
“বাপজান, রোগ-ব্যারাম কিছু নয়। জ্যান্ত মানুষটাকে মেরে ফেললো।”
“কনে?” (কে?)
“আর কে, হিন্দুরা।” উহ্ করে একটু বুকভাঙ্গা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।
হাসিম ঠিকমতো ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। কেন হিন্দুরা মারবে তার স্বামীকে? বিশদ জানবার জন্য আবার শুধোয়ঃ
“তোঁয়ারার জাগা-জমিন ন আছিল?” (সেখানে তোমার জায়গা জমিন ছিলো?)।
“বাপজান, আট বিঘে ধানের জমি ছিলো, ভিটি ছিলো, বাগান ছিলো, ঘর ছিলো এবং মুখে বলা যায় না এমন অনেক কিছু ছিলো। জল-হাওয়া… আলো।”
কেন এ যাওয়া-আসা? হিন্দুরা পাকিস্তান থেকে হিন্দুস্তানে যায়, হিন্দুস্তান থেকে মুসলমানরাও বা আসে কেন? কেন আসে? কেন যায়?
“জাগা-জমিন ছাড়ি আইলা ক্যা?” (জায়গা-জমি ছেড়ে এলে কেন?)
“ডরে, বাপজান, ডরে।”
“এই দেশত ত ব্যারামে আর অভাবে মরণের দশা অইয়ে।” (এই দেশেও তো রোগে আর অভাবে মরণের অবস্থা হয়েছে।)
“বাপজান, মরণের কি ভয়?”
“ভয় কারে?”
“ভয় ত হিন্দুদের।”
ভয় শুধু হিন্দুকে? হিন্দুরা কি মরণের চাইতেও ভয়ঙ্কর? হিন্দুদের মধ্যে কি ভালো মানুষ নেই? মুসলমানদের মধ্যে কি খারাপ মানুষ নেই? জাহেদ বকসু, খলু মাতব্বর, কানা আফজল এরা কি ভালো মানুষ? হেডমাষ্টার গিরিজাশঙ্করবাবু যিনি মুসলমানের ছেলের প্রাণরক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন তিনি কি খারাপ মানুষ? হাসিমের ধারণা কানা আফজল আর অধরবাবুরা একযোগেই তো মৃত্যুর ব্যাপার করে। ওরা হিন্দু নয়, ওরা মুসলমান নয়, ওরা একজাত-অত্যাচারী। এ সত্যটা মানুষ বোঝে না কেন? কেন বোঝে না? ভয়ানক দুঃখ হয়, যে-দুঃখের কোনো রূপ নেই।
আপাততঃ সমিতির কাজ চুকিয়ে বুকিয়ে দিয়েছে। এখন ঘরে ফেরা দরকার। সুফিয়ার কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হয়ে ওঠে হাসিম। তার দিন কি রকম করে কাটছে কে জানে। সেদিনই বাড়ির উদ্দেশ্যে পথে বেরিয়ে পড়ে। বাড়াবাড়ির বটতলার নবীর দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকে দেখে দোকান ভর্তি মানুষ সশব্দে হেসে ওঠে। সম্মিলিত হাসির শব্দে একটু দিশেহারা হয়। অন্যদিন হলে ভয় পেতো। আজকে তার করুণা হলো। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে জানে না বলেই হাসছে ওরা। তাদের স্থান কোথায় যদি সঠিকভাবে জানতে পারতো, তাহলে তাদের হৃদয়েও দয়া জাগতো, উথলে উঠতো প্রেম। তাকে টিটকিরি দেয়। গায়ে মাখে না হাসিম। ছতুর বাপ তসবীহ্ রেখে দাড়ি দু’হাতে মুঠি করে শ্লোক উচ্চারণ করলোঃ
“অকুলীন কুলীন অইব কুলীন অইব হীন
অকুলীনে দুঁড়াইব ঘোড়া কুলীনে ধরিব জ্বীন।”
ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো ওজন করে দেখে হাসিম। কোনো মানুষের ভালো কামনা করার মতো মন এদের নয়। তেমন তীক্ষ্ণ নয় দৃষ্টিরেখা। গভীর নয় অনুসন্ধিৎসা। প্রবল নয় ভালোবাসা। তাই কেউ ভালো কাজ করতে গেলে সম্ভাব্য সকল উপায়ে নাজেহাল করা চাই তাদের। এটা তাদের মনের চরম দুর্বলতার অভিব্যক্তি। যার কিছু করার ক্ষমতা আছে করবে। বেহুদা কথা কয় না সে। তাদেরকে তো চিনেছে হাসিম। তাদের পরিচয় কি অনুদঘাটিত? তাদের প্রাণ আছে বটে শরীরে, তবে সে প্রাণ নিজেদের এখতিয়ারে নয়। জাহেদ বকসুর হুকুমে লাগান অথবা খলু মাতব্বরের দাঙ্গায় বিসর্জন দেবার জন্য তৈরি করে রেখেছে। মানুষের লহুর স্পন্দন তাদের শিরায় কই?
পাড়ায় ঢুকবার মুখে নারী-কান্নার তীক্ষ্ণ শব্দ তার কানে আসে। অভ্যেস অনুসারে স্বরের অনুসরণে ছোটে। তার নিজের পাড়ায়ও কি লাগলো ওলাউঠা, জহির মৌলভী কিছু করতে পারলো না নাকি? কি করতে হবে মনে মনে সে কথা চিন্তা করে। পুকুরের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে চেকন ঘাসে ঢাকা কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথটা বেয়ে অতি সন্তর্পণে হাসিম হাঁটতে থাকে। যে-কোনো মুহূর্তে সাপে কাটার আশংকা। তখন সন্ধ্যা চারদিকে। জীবন্ত অন্ধকার পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। সে আঁধার সাঁতরে ছদুর মা’র উঠোনে এসে দাঁড়ালো। ছদুর মা গলা ছেড়ে কাঁদছে। এবার তার কাঁদবার ঋতু। বৌটা একগালে একটা হাত দিয়ে স্বামীর মৃত্যুর সংবাদটা যাচাই করছে। কদিন আগেও যোয়ান মানুষটা বেঁচে ছিলো। কাঁচা বউটি, অল্প বয়েস। একটি ছেলেপুলেও জন্মায় নি। কচি পাটের চারার মতো আন্দোলিত শরীর। আজ খবর পেয়েছে, ছদু তিনদিন আগে শহরের হাসপাতালে জননী আর প্রিয়তমার মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। এমন স্বাস্থ্যবান সুঠাম সুন্দর সবল শালকাঠের মতো যুবক ছদু–মারা গেলো? আহা রে! আহা রে! রক্তমাখা বিক্ষত চেহারাটা ভেসে ওঠে। সে প্রাণ আর নেই। আলো হয়ে, হাওয়ায় মিশে গেছে। কলজের ভেতর কে যেন সাঁড়াশী দিয়ে টানছে। বউটা পানি ফেলছে দু’চোখের। শ্রাবণের ধারার চাইতেও ঘন। এবং দীর্ঘতরো। মাটা ডানাভাঙ্গা ঘুঘুর মতো কাতরাচ্ছে। উঠোনের কাদায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। বুকে কিলের পর কিল মারছে। বিধবার একমাত্র সন্তান ছদু। গ্রামের মান ইজ্জতের সঙ্গে যার ছিলো প্রগাঢ় সম্বন্ধ। শূন্যচারী ঈগলের মতো ছিলো যার দুঃসাহস, সে ছদু আর নেই। ওলাউঠার মৃত্যু দেখেছে। সে এরকম অণুপরমাণু নিঃসার হয়ে, হাত-পা শীতল হয়ে নীরবে নীরবে ঠাণ্ডা হয়ে ঝরে পড়া মৃত্যু। কিন্তু ছদু-তার রক্তাক্ত মৃত্যু বুকে একবুক টনটন জ্বালা দিয়ে যায়। সহজভাবে নিতে পারে না। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে পারে না। আবেগেরা স্পন্দিত হয়ে কথা কয়। বজ্রাহত মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকে হাসিম। আরো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে–তারাও বজ্রাহত। পরিস্কার মেঘমুক্ত নিথর আকাশ থেকে একটা বজ্র অনেকগুলো কালো মাথায় নেমে এসেছে–ছদু নেই, বেঁচে নেই, সে কথা বরগুইনির দু’পাড়ের বাতাসে আজ বেজে উঠেছে।