সমিতির জেলা অফিস থেকে কাজ করবার জন্যে একটা মানুষ এসেছে। সারাদিন তাদের সঙ্গে ঘুরে মরা পোড়ায়, কবরস্থ করে। রোগীর সেবা করে। দুটো পেলে খেয়ে শুয়ে পড়ে যেখানে সেখানে। যেমনি সরল, তেমনি কঠিন মানুষটা। বেশ লেখাপড়া জানে। সকলের কেরামত ভাই। কতো কতো দেশ ঘুরেছে। কেরামত ভাই চাটগেয়ে ভাষায় কথা বলতে পারে না। তবু মর্মার্থ বুঝতে তাদের কারো অসুবিধে হয় না। হাসিমের মনে হয়, স্নেহ, প্রেম আর ভালোবাসার ভাষা দুনিয়ার সবদেশে এক। আরেকটা তেমন ভাষা আছে, তাও এক– সে সংগ্রামের ভাষা।
ঘরে আসতে পারে না বেশি। দলাদলা মানুষ মরছে। মাটি দিতে হচ্ছে, পোড়াতে হচ্ছে। জাত বিচারের সময় নেই। জাত বিচার করলে যে মৃতের সত্যার হয় না। এ পর্যন্ত ছেলে-বুড়ো-জোয়ান সব মিলিয়ে মরেছে একশো পঁচিশজন। মনির আহমদ শহরে গিয়ে ওপরে দরখাস্ত করে ডাক্তার আনিয়েছে, পুকুরের পানিতে ওষুধ ছড়িয়ে দিয়েছে। পানিতে রোগের পোকা বাড়ে। জীবানু মিশেল পানি খেলে রোগ সংক্রামিত হয়। টিকা দেবার ব্যবস্থা করেছে। গ্রামের মানুষ টিকা নিতে চায় না। তাতে নাকি ঈমান চলে যায়। এ কথা শুক্কুরবারের জামাতে ফয়েজ মস্তান মুসুল্লীদেরকে বলে দিয়েছে। কাজী পাড়া এবং ফকির পাড়ার সকলে একযোগে ফয়েজ মস্তান জহির মৌলভীকে নিয়োগ করেছে। ছাগল জবাই করে শিরনি দিয়েছে। কোরআনের আয়াত পড়ে পাড়া বন্ধ করেছে। মাটির সরায় সুরা লিখে গাছে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে, যাতে করে ওলাউঠা পাড়ার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে না পারে। দিনেরাতে শোনা যায় আজানের ধ্বনি। জীবনে যারা নামাজ পড়ে নি ওলাউঠার ডরে তাদের মাথায়ও টুপি উঠেছে। রাতের বেলায় ফয়েজ মস্তান আর জহির মৌলভী জেগে থেকে সমস্ত পাড়াময় ঘুরে বেড়ায়। মাইজ ভাণ্ডারের কোন্ কামেল পীর নাকি স্বপ্নে দেখেছে মানুষের গুনাতে দুনিয়া ভরে গেছে। সে জন্য আল্লাহ্ বান্দার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে কলেরা, হাম, বসন্ত প্রভৃতি সাতবোন পাঠিয়ে গজব নাজেল করছে। ওরা সুন্দরী মেয়েলোকের বেশ ধরে দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াবে। যে পাড়ায় আল্লাহর কালামের কোনো নিষেধের গণ্ডী থাকবে না, ভেতর দিয়ে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়বে। হেঁটে গেলেই শুরু হবে রোগ। তারপর মৃত্যু… কান্নাকাটি ইত্যাদি। এরই নাম আসমানী মুসিবত। এই আসমানী মুসিবতেরও আসানী আছে আল্লাহর কালামে। একবার জহির মৌলভী নাকি জোয়ারা গ্রামে রাতের অন্ধকারে এক বোনের মাথার লম্বা চুল জারুল গাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে খরম দিয়ে হেঁচতে হেঁচতে মুচলেকা আদায় করেছিলো। আল্লাহ্র হুকুম নেই, নয়তো ধরে রেখে দিতো। একথা জহির মৌলভী যত্রতত্র বলে বেড়ায়। আর সেজন্য কলেরার সময় জহির মৌলভীর এতো দাম।
একমাস আগে হাসিম এসবে মোটেও অবিশ্বাস করতো না। কিন্তু আজকে তার কেবল হাসিই আসে। এরকম সুন্দর সুন্দর গল্প বানাতে পারে বলে মোল্লারা খেতে পায়। ওসব কিছু নয়, ভাওতা। মুর্গীর রান খাওয়ার আর মেহনতকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এসব মোল্লারা বানিয়েছে।
জ্যৈষ্ঠের শেষ। আষাঢ় নেমেছে। আউশ ধানের কচি সবুজ রঙে শ্যামায়িত হয়েছে মাঠ। মাঠে মাঠে গঙ্গাফড়িং ছুটোছুটি করছে। মেদুর মেঘ সরে গিয়ে সুন্দর চড়চড়ে রোদ উঠেছে। রক্তের মতো লাল হয়ে উঠেছে। এখন সমিতির বিশেষ কাজ নেই। বলতে গেলে মড়ক থেমে গেছে। সে জন্যে হাসিমদের পেটের ভাত চোখের ঘুম বিসর্জন দিতে হয়েছে অনেকদিন। পুকুরে পুকুরে ওষুধ ছড়িয়েছে, ঘরে ঘরে ফিনাইল, ব্লিচিং পাউডার বিলিয়েছে। কেরামত ভাই এসে তাদেরকে সুন্দর সুন্দর অনেক কাজ শিখিয়ে দিয়েছে। রোগীর সেবা করা, কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস করানো, মশা-মাছি ধ্বংস করার তেল ছড়ানো-সব কিছু শিখে ফেলেছে হাসিম। কৃষক সমিতিতে যোগ না দিলে এসব শিক্ষা কোথায় পেতো? মানুষের জীবন রক্ষার জন্য কতো প্রয়োজন–এসব কি কম মূল্যবান অভিজ্ঞতা!
আরো অনেক মূল্যবান মণিমুক্তো সঞ্চিত হয়েছে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডে। ছোট ছোট টুকরো টুকরো সে সকল অভিজ্ঞতা, হাসিমের মনে হয়েছে তার গুরুত্বি অপরিসীম। অভিজ্ঞতার শুদ্ধ আলোতেই সমাজের ভাঁজে ভাঁজে জমা ক্লেদ পঙ্কিলতা স্পষ্ট দেখতে পায়। কিছুদিন আগে হাসিমেরা লাশ কবর দেওয়ার জন্য রিফুজি পাড়ায় গিয়েছিলো। পাড়াটা বসেছে দু’বছর আগে। বুড়ীর ছোট ছেলেটার ওলাউঠা হয়েছে। খবর পেয়ে মনির আহমদ হাসিম আর কেরামতকে পাঠিয়ে দিলো।
ভাঙা ঝুরঝুরে বেড়ার ঘরে ছেঁড়া মাদুরের ওপর বুড়ীর ছেলেটা নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। সারা ঘরে ভন ভন উড়ছে বড় বড় মাছি। রোগী পায়খানা, প্রস্রাব করে সবকিছু একাকার করে ফেলেছে। বদবুয়ের জন্য কাছে আগানো যায় না, সে অসহনীয়। বদবুকে অগ্রাহ্য করে বুড়ী মৃত্যুকল্প সন্তানের শিয়রে বসে আছে। চোখে মুখে আতঙ্ক… ক্লান্তি… শোক একসঙ্গে বাসা বেঁধেছে। হাসিমেরা সে ময়লা পরিষ্কার করছিলো। মনির আহমদ ডাক্তার এনে চিকিৎসা করে মৃত্যুকল্প বালককে বাঁচিয়ে তুলেছিলো। তিনদিন হাসিমকে বুড়ীর সঙ্গে সঙ্গে রোগীর বিছানায় বসে কাটাতে হয়েছে। চারদিনের দিন চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলো রোগী। সন্তানকে চোখ মেলতে দেখে বুড়ীর দু’চোখে অশ্রুর ধারা নেমেছিলো। অথচ বুড়ীর চোখ এতোদিন ছিলো আশ্চর্য রকমের শুকনো। এ ভাবান্তর দেখে হাসিম আবাক হয়ে গেলো। সন্তান ভালো হয়ে উঠেছে এতে কাঁদবার কি থাকতে পারে? বুড়ীকে জিজ্ঞেস করেছিলো কেন সে কাঁদছে। জবাবে বলেছিলোঃ