“হাসিম বাই কত্তে আইস্যোদে?” (হাসিম ভাই কখন এসেছো?)
“এককেনা আগে, চন্দ্রকান্ত চাচাও আইস্যে।” (একটু আগে, চন্দ্রকান্ত চাচাও এসেছে।)
“কই?”
“চাচা কাজর তাড়াতাড়ি। বেশি কথা কইত ন পাইরলাম, এহন আইয়ো চিনা পরিচয় গরাই দি।” (চাচা কাজের খুব তাড়াতাড়ি। বেশি কথা বলতে পারছি না, এসো চেনা জানা করিয়ে দিই।)
মনির আহমদ দু’জনকে নিয়ে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। দু’জনকে খুব আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলো সকলে। আন্তরিকতার স্পর্শে অল্পক্ষণের মধ্যে তাদের সঙ্কোচ কেটে যায়। খুবই সহজভাবে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে থাকে। চন্দ্ৰকান্তের উৎসাহ হাসিমের চেয়ে বেশি। এটা কি, ওটা কি, জেনে নিয়ে প্রত্যেকটা কাজ বেশ আগ্রহ সহকারে করে যাচ্ছে।
এগারোটার গাড়িতে নেতারা এলে অন্যান্যদের সঙ্গে তারাও অভ্যর্থনা করে আনতে গেলো। দশ গ্রামের কৃষক এসে জমায়েত হয়েছে। তাদের সঙ্গে এক মিছিলে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুললো। আওয়াজ তুললো চন্দ্রকান্ত। প্রথমে হাসিমের গলাটা কেঁপে উঠলো। জিহ্বায় কেমন যেন জড়তা, কিসের যেন আওয়াজ একসঙ্গে সমুদ্রের মতো ফেটে পড়েছে। কোত্থেকে হাসিমের বুকেও এলো সাহস। গলা ফাটিয়ে ঘোষণা করলোঃ
জালেম গোষ্ঠী ধ্বংস অউক
চাষী-মজুর ভাই ভাই
অন্ন চাই বস্ত্র চাই
লাঙ্গল যার জমি তার
বাঁচার দাবীকে উর্ধ্বে তুলে ধরার চাইতে রোমাঞ্চকর উত্তেজনা কি কিছু আছে জগতে? নেতারা এলে হাসিম আর চন্দ্রকান্ত চলে আসতে চাইলো। কিন্তু কৃষক সমিতির কর্মীরা আসতে দিলো না। নেতাদেরসহ ডালে-চালে খিচুড়ী পাক করে সকলে একসঙ্গে খেলো। এসব অভিজ্ঞতা হাসিমের নতুন। খাওয়ার ব্যাপারে চন্দ্ৰকান্তের বরাবর একটা খুঁতখুঁতে স্বভাব ছিলো। আশ্চর্য, চন্দ্রকান্ত চাচাও বিন্দুমাত্র আপত্তি করলো না।
সভার নেতারা বক্তৃতা করলেন। মনে হলো না যেন তারা দূরের মানুষ। যেন তাদেরই একান্ত আপনজন– কাছের মানুষ। দুঃখ-দুর্দশাকে সোজা ভাষায় সহজভাবে চোখের সামনে তুলে ধরলো না শুধু, কারণগুলোও বর্ণনা করলো। শ্যামল চেকন তলোয়ারের ফলার মতো আন্দোলিত শরীরের মানুষটার কথাগুলো তার চেতনায় সঙ্গীতের মতো বাজতে থাকলো।
এক সময় নাকি সমাজের সকলে সমান ছিলো। সকলে সমানভাবে স্বাধীন ছিলো। দাস ছিলো না কেউ কারো। সকলে সমানভাবে পরিশ্রম করতো, সমানভাবে ফলভোগ করতো। কেউ বড় কেউ ছোট ছিলো না। মানুষ মানুষের মেহনত চুরি করে মানুষকে দাস বানিয়ে রেখেছে। কৃষক-শ্রমিকের বুকের খুন-ঝরা মেহনত চুরি করে ধনী হয়েছে মানুষ। মেহনতী মানুষের বুকের তাজা রক্ত তাদের বাগানে লাল লাল গোলাপ হয়ে ফোটে। সহস্র রকম পদ্ধতিতে বুকের রক্ত শুষে নিচ্ছে। হাসিম যেন চোখের সামনে শোষণের নলগুলো দেখতে পেলো। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এ শোষণের পথ বন্ধ করতে হবে। সেজন্য দরকার সমিতি। ঘরে ফেরার সময় বক্তৃতার কথাগুলো হাসিমের চেতনায় বারংবার আবর্তিত হয়ে ঘোরে। পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিকের শ্রম চুরি করে ধনীরা বালাখানা গড়েছে। হাসিম তো শ্রমিক, তারও শ্রম চুরি করেছে। এতোক্ষণে ধরতে পেরেছে অধরবাবু, কানা আফজল আর খলুদের সঙ্গে তার মতো মানুষদের তফাৎটা কোথায়। বক্তৃতার আলোকে চেনা মানুষদের নতুন করে খুঁটিয়ে দেখে। তাদের শরীর থেকে যেনো লাল লাল তাজা রক্ত ঝরছে। আর অধরবাবুদের মুখে রক্তের ছোপ। প্রবল উত্তেজনায় দু’হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো।
“জয় রাধামাধব,” একেক জনের কথার জোর কি রকম। চন্দ্রকান্ত ফিক করে হেসে ফেললো।
“চাচা, রাখি দাও তোঁয়ার রাধামাধব। বেবাক দুনিয়া ভরা শোষণ, শোষণে রক্ত নাই, হাড্ডিত ঠেহাইয়ে আনি। এতো শোষণ তবুও মাইনষের ঘুম ন ভাঙ্গে ক্যা?” (চাচা রেখে দাও তোমার রাধামাধব। সমস্ত দুনিয়া জুড়ে চলছে শোষণ। রক্ত শুষে এখন হাড়ে এসে ঠেকেছে। এতো শোষণ তবু মানুষের ঘুম ভাঙ্গে না কেন? উত্তেজনার বশে কঠিন মাটিতে দুম করে একটা পদাঘাত করলো।
৫. হাসিম গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়
হাসিম গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী। সমিতির মানুষদের কাজ অনেকগুণ বেড়ে গেছে। ফুরসত নেই কারো একদণ্ড। খাবার জিনিসের দামে আগুন লেগেছে। ডাক্তার বদ্যি পাওয়া যাচ্ছে না মোটেও। একেকজন মানবসন্তান নীরবে বিনা চিকিৎসায় বিনা পথ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
এতোদিন হাসিম নিজের দুঃখকেই বাড়িয়ে দেখেছিলো। আশপাশের মানুষের হাল হকিকত নজর মেলে দেখে নি। তার পক্ষে দেখবার উপায়ও ছিলো না। বাস্তবে কাজ করতে নেমে দেখতে পেলো পৃথিবীতে সে শুধু একমাত্র দুঃখী নয়। আরো মানুষ আছে, যাদের অবস্থাও তার চাইতে কোনোক্রমে ভালো নয়। তার মতো হাজারো হাজারো মানুষের জীবনের চারপাশে ঘিরে রয়েছে কঠিন করুণ বাস্তবতা। আঘাত খেয়ে রক্ত ঝরে, হৃদয় রক্তাক্ত হয়, সামনে এগিয়ে যাবার পথ পায় না জীবনে। মানুষের জীবনের মিছিল সে আলোহীন নিশুতির গাঢ় অন্ধকারে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন পাওয়া চেতনার আলোকে সবকিছুর মর্মমূল পর্যন্ত কেটে চিরে দেখে। এতোদিন সেও আকাশের দিকে মুখ তুলে মানুষের দুঃখ-বেদনার অবসান কামনা করতো। সমিতির কর্মীদের সঙ্গে কাজ করে, আলাপ-আলোচনা করে সে বুঝতে পেরেছে, মানুষ নিজেকেই তার ভবিষ্যৎ রচনার ভার হাতে তুলে নিতে হবে। ওপর থেকে কোনো আসমানী রহমত এসে মানুষের দুঃখ আর অভাব দূর করবে, সে অসম্ভব কথা। হাজার মানুষের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে সে যখন তার নিজের দুঃখও মিলিয়ে দেখলো, তখন অনুভূতির আয়নাতে সুন্দর ধারণা ফুটে উঠলো–সেও মানুষ। সমিতির লোকদের সঙ্গে কাজ করে ক্রমশই ধারণা আপনার থেকেই বদ্ধমূল হয়েছে যে, সেও মানুষ। জীবন অমূল্য সম্পদ, অসম্ভবকে সম্ভব, অসুন্দরকে সুন্দর করার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করার নামই জীবন। ক্ষয়ে ক্ষয়ে ধুকে ধুকে মরার জন্য মানুষ পৃথিবীতে আসে নি। সমস্ত পরিশ্রম, সমস্ত আকাঙ্খ, সমস্ত স্নেহ ঢেলে দিয়ে জীবনকে মাটির পৃথিবীতে দাঁড় করাতে হবে সুন্দর করে। কেউ কারো চেয়ে পৃথক নয় একই রক্তের নদী ছুটছে সমস্ত মানুষের ধমনীতে। সকলকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন সকলের সমবেত প্রচেষ্টা। একা থাকার মধ্যে তৃপ্তি নেই। কেননা একা থাকলে অতি সহজে নেতিয়ে পড়ে। সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা থাকে না। জীবনের সুখ মানেই তো জীবনের সংগ্রাম। সামনের উজ্জ্বল আশা আর পেছনের উদ্দীপনা না থাকলে মানুষ পারে না সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। অবসর সময়ে হাসিম বসে বসে এসব কথা ভাবে। এ ক’দিন সমিতির কর্মীদের সঙ্গে কাজ করে এমন একটা আতস কাঁচ সে পেয়েছে যার ভেতর দিয়ে দেখল জাহেদ বকসু, খলু মাতব্বর, কানা আফজল সকলকেই তাদের আসল চেহারায় দেখা যায়, চেনা যায়। নিরন্ন ভুখা মহামারীর আক্রমণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষদেরকেও চেনা যায়। রাতে ঘুম আসে না, বিছানায় শুয়ে ছটফট করে।