এখনো যেন দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। পরনে শতচ্ছিন্ন হাঁটু ধুতি। গায়ে বুক চেরা ফতুয়া। সারা শরীরখানা গাব রাঙানো জালের উজ্জ্বল তুলিতে ছাপানো। কালীনাগের মতো চকচকে কালো। সাপের ফণার মতো পেশীগুলো। অভ্যন্তরে লুকিয়ে আছে শক্তি যে শক্তি দিয়ে পাহাড় পাথর চুরমার করা যায়। দাঁড়িয়ে আছে স্থির নিস্পন্দ, নিষ্পলক। চোখজোড়া দুরূহ জিজ্ঞাসায় বিষণ্ণ। তেলীপাড়ার তেজেন। চিনতে এতোটুকু কষ্ট হয়নি হাসিমের। দাঁড়িয়ে আছে মাটি থেকে একহাত ওপরে। ঘরের গাইয়ের শক্ত পাকানো নতুন দড়িখানা গলায় কষে লেগেছে। কিছু দূর কেটে গেছে। দড়িতে ক’ফোঁটা রক্ত। হাসিমই তো পয়লা দেখেছিলো। সে যাচ্ছিলো পাহাড়ে। ভোর রাত। মোরগ বাগ দেয়নি। পৌষালী কুয়াশার জমাট আস্তরণের ভেতরেই দেখেছিলো। চিনেছিলো তেলীপাড়ার তেজেনদার না হলে শিশুকাঠের মতো অমন সবল শরীর আর কার? তাই ডাক দিয়েছিলোঃ
“তেজেনদা, এত রাতিয়া কিল্লাই বাইর অইয়স যে”। (তেজেনদা, এতো রাতে কেন বেরিয়েছো?)
তেজেনদা কোনো জবাব দেয়নি বার বার ডাকার পরও। কাছে এসে গায়ে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো হাসিমঃ
“কি তেজেনদা রাগ অইয়স যে না কথা ন কস ক্যা?” (কি তেজেনদা, রাগ করছো, কথা বলছো না কেন?)
গাছের ডালে ঝুলন্ত শরীর তেজেনের দুলেদুলে জবাব দিয়েছিলো। হা, সে রাগ করেছে, সমগ্র পৃথিবীর ওপর তার রাগ। সমস্ত মানুষের ওপর অভিমান। তাই সে কথা বলবে না; কোনো দিন কথা বলবে না। সকাল হলে পরে হাসিম ঝুলেপড়া জিহা, রক্তের স্বাক্ষর আঁকা রঞ্জু আর তেজেনদার দু’চোখে সে একটি উদ্ধত জিজ্ঞাসাই দেখেছিলো, আরো সকলে দেখেছিলো। কেউ কোন কথা বলে নি। কেবল ছতুর বাপ তসবীহ্ টিপতে টিপতে মন্তব্য করেছিলো।
“আত্নহত্যা মহাপাপ। কাফের এনে তো যাইত দোযখ। একই কথা। ফি নারে জাহান্নামে হালেদিনা।” (কাফের এমনিতেও নরকে যেতো, একই কথা, তার জাহান্নাম নরকে স্থান)
কোনো হিন্দু মরলে তাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বালাবার অনুরোধ করাটাই বিধি। অভাব, দুঃখ, নির্যাতন, উপবাস থেকে মুক্তি পাবার আশায় শীতজর্জর পৌষের এক কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে গাছের ডালের সঙ্গে এক মাথা, দড়ির আরেক মাথা নিজের গলায় পরিয়ে ধাক্কা দিয়ে মইটা ফেলে ঝুপ করে ঝুলে ছিলো মুক্তির আশায়। হাসিমের এখনো চোখের সামনে ভাসে তেজেনদার চিরতরে নির্বাক হয়ে যাওয়া চোখের সে প্রশ্নিল দৃষ্টি।
বুকের সমস্ত বেদনা মথির করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। হায়রে! আল্লাহ, এতো অত্যাচার তোর রাজ্যে। হাতির মতো বলবান তেলীপাড়ার তেজেনদাকেও গলায় দড়ি দিয়ে মুক্তি খুঁজতে হলো। শ্বাস নিতে পারে না হাসিম। বুকের ভেতর তেজেনদার সে জিজ্ঞাসা যেন সূচীমুখ কোনো তীক্ষ্ণতম যন্ত্রণার মতো বাজে। সে নড়েচড়ে বসে।
বেলা পড়ে এসেছে। সূর্য হেলেছে পশ্চিমে। পেটের ক্ষুধাটাও চাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই কবে সাত সকালে দু’টো পানি ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। আজকাল একভার লাকড়ির জন্যও বাঁশমুরায় (জঙ্গলে) না গিয়ে উপায় নেই। শালার কন্ট্রাকটারেরা ধারে কাছে কিছু রাখেনি। এ পাহাড়, সে পাহাড় কতো পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। একেকটাতে উঠতে বুকের লহু গেছে পানি হয়ে। যাওয়া আসায় বারো মাইলের কম পথ তো তাকে হাঁটতে হয়নি। অন্যদিন কলাপাতায় ‘মোচা বেধে ভাত নিয়ে যায়। গতকাল বাজার থেকে চাল, তরকারী কিছু আনতে পারেনি বলে ভাতও নিতে পারেনি। পেটের ক্ষুধাটা যতোই চাড়া দিচ্ছে, ততই তার উঠতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ঘরের কথা মনে হতেই ওঠবার শক্তি আপনা থেকে হারিয়ে ফেলে। পা দুটো মাটির মতো হয়ে মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকে।
ঝম্ ঝম্ শব্দ করে রেলের গাড়িখানি বরগুইনীর লোহার পুলের ওপর দিয়ে চলে গেলো। পড়ন্ত সূর্যের আলোতে চিকচিক্ জ্বলে। হাসিমের মনে চিন্তা… একমুঠো ভাতের চিন্তা। পোড়া চোখ ধায় রূপের দিকে, কিন্তু…।
বিল কোণাকোণি পথে বানা্যা পুকুরের পাড়ে উঠে এলো অধরবাবু। পেছনে ছেলেটা। ছেলেটার হাতে মাছ রাখার ডুলা। অধরবাবুর হাতে জাল। জালের পাক খুলে এদিকে সেদিকে কয়েকটা খেপ দিলো। একটা মাছও আসেনি। তারপর অগ্নিকোণ বরাবর জালটা সড়ত করে আমগাছে নিবিড় ছায়া যেখানে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানেই ছুঁড়ে মারলো। জাল মাটিতে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই ওপর দিকে ঠেলে লাফ দিলো চওড়া বালিশের মতো একটা মস্ত রুই। লাল মুখ লাল পাখনা দেখা গেছে পরিষ্কার। সাদা আঁশগুলো রূপোর টাকার মতোন ঝিলমিল করে জ্বলে উঠলো। ছিঁড়ে যেতে পারেনি। রেশম সুতোর জাল, খেপের তলায় যক্ষ পড়লেও বেঁধে রাখে। লুঙ্গিটা মালকোঁচা দিয়ে গলা জলে নেমে এলো অধরবাবু। ডুব দিয়ে জালটাকে মাছের শরীরের সঙ্গে আচ্ছা করে জড়িয়ে কোমর জলে আসে। মাছের হেঁচকা টানে অধরবাবুর লিকলিকে শরীর বার বার বাঁকা হয়ে যাচ্ছে ধনুকের মতো। শেষ পর্যন্ত মাছ জড়ানো জাল একেবারে পারের সমতলে এনে রাখলো। বিরাট রুইটা শুকনো ডাঙার ওপর দাপাদাপি লাফালাফি করছে। পুচ্ছ তাড়না আর বাতাসে খাবি টানছে। অধরবাবুর মুখে বিজয়ীর হাসি। নিজের জালে ধরা মাছ কিনা, দেখতেও সুখ।
হাসিম ধড়ফড়ানো রুইটার কছেল্লা দেখে পায়ে পায়ে একেবারে অগ্নিকোণে চলে এলো। ইঃ বাবা, কতো বড়ো রুই! লেজ পাখনা লাল হয়ে গেছে। কতো বছরের পুরানো কে জানে। বড়ো চালাক মাছ। পানি কমে গেছে, তাই ধরা পড়লো। মাছটার পুচ্ছ তাড়না তার স্মৃতিতে তেজেনদাকে ডেকে আনে। হয়ত তেজেনদাও ঝুলে পড়ে এমনি করে ধড়ফড় করছিলো। হঠাৎ মনে হয় এই মাছটি তেজেনদা, আর তার ভাগ্য যেন একসুত্রে বাঁধা পড়ে গেছে। আরো কতো ভাবনার উদয় হয় মনে। আকারহীন অবয়ভহীন সব ভাবনা।