“হুইনলাম খলু চাচা, তোঁয়ারা দাঙ্গা গরিবার লাই তৈয়ার অইয়ো। আঁরা আস্যিদে মীমাংসার লায়। কি লাভ চাচা মারামারি কাড়াকাডি গরি? তারথুন মীমাংসা বউত ভালা। তারপরে কোর্ট-কাঁচারীতে দৌড়ন লাগিব। তিন কানির লায় দশকানির টেঁয়া খরচ গরন লাগিব।” (শুনলাম খলু চাচা, তোমরা দাঙ্গা করবার জন্য তৈরি হয়েছে। আমরা এসেছি মীমাংসার জন্য। মারামারি কাটাকাটি করে কি লাভ? তার চেয়ে মীমাংসা খুব ভালো। কোর্ট-কাঁচারীতে দৌড়াতে হবে। তিনকানির জন্য দশকানির টাকা খরচ করতে হবে।)
“তেঁরা কন মীমাংসার কথা কইবার? তোরা কি গেরামর মেম্বর-চেয়ারম্যান?” (মীমাংসার কথা বলবার তোমরা কে? তোমরা কি গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যান?)
“আঁরা সমিতির মানুষ চাচা।” (আমরা সমিতির মানুষ চাচা।) জবাব দিলো মনির আহমদ।
“তোরার সমিতি ভরে আঁই মুতি, দুত্তোর সমিতি। মীমাংসার কথা কইলে কইব চেয়ারম্যান সা’ব।” (তোমাদের সমিতিতে আমি প্রস্রাব করি, দুত্তোর সমিতি। মীমাংসার কথা বললে বলবে চেয়ারম্যান সাহেব।)
এরপরে আর কথা বলা যায় না। সকলে সুর সুর করে বেরিয়ে আসে। আকাশে অষ্টমীর চাঁদ জেগে আছে। পৃথিবী সুপ্তিমগ্ন, গভীর প্রশান্তিতে মৌন সমস্ত চরাচর। সমিতির কর্মীরা কানভরে গভীর পৃথিবীর পাঁচালী শুনে যেন। খলু মাতব্বরের বৈঠকখানায় চুপি চুপি নরহত্যার মন্ত্রণা চলছে।
পরের দিন বরগুইনির দু’পাড়ের দু’গ্রামের মানুষ খুব সকালে শয্যাত্যাগ করে। আজকের দিন ভয়ঙ্করের বার্তা নিয়ে এসেছে। গাছবাড়িয়ার জোয়ানেরা সকলে মাথায় লাল পাগড়ী বেঁধে মাতব্বরের উঠোনে সমবেত হয়েছে। একটু পরেই সকলে খেতে বসলো। সপের দু’ধারে সার সার মাটির সানকী। এমন সময় হাসিমের খোঁজ পড়লো। হাসিম আসেনি। এতো বড়ো বুকের পাটা বানিয়ার পুতের? পাড়ায় থাকবে অথচ দশজনের কাজে আসবে না। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে ছদু। গর্বিত পদক্ষেপে হাসিমের উঠোনে এসে হাঁক দেয়ঃ
“বান্যিয়ার পুত, এই বান্যিয়ার পুত।” (বেনের ছেলে, এই বেনের ছেলে।)
বারবার ছদুর অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে। হাসিম কালকের রাখা পান্তাভাত খাচ্ছিলো। ডাক শুনে বাইরে এসে ছদুকে দেখে মুখের কথা মুখে আটকে থাকে। হাতে লাঠি, মাথায় লাল কাপড়ের পাগড়ী। অন্তরটা পর্যন্ত শিউরে ওঠে। কোনো রকমে জিজ্ঞেস করে, কথাগুলো জড়িয়ে যায়ঃ
“কি মামু?” (কি মামা?)
“কুত্তার বাইচ্চা যাতি নয়? (কুত্তার বাচ্চা, তুই কি যাবি না?)
“মামু আঁর শরীর ভাল না।” (মামা আমার শরীর ভালো নয়।)।
সুফিয়া ছদুর উগ্রমূর্তি দেখে ভয় পায়। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে একখানা সিঁড়ি এগিয়ে দেয়।
“মামু বইয়ো।” (মামা বসো।)
ছদু পিঁড়িটাকে লাঠি দিয়ে উলটিয়ে ফেলে। ঠকঠক কাঁপা পা দুটো জোড় করে ছদুর ভয়ঙ্কর মূর্তির সামনে একান্ত বশংবদের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সুফিয়া দু’হাতে ছদুর পা দুটো জড়িয়ে ধরে।
“মামু, জ্বরতথন উইঠ্যেদে আজিয়া মোডে চারদিন। ঠ্যাংগর ফুলা ন কমে। মামু তুই ন বাঁচাইলে কেউ বাঁচাইত পাইরত নয়।” (মামা, জ্বর থেকে উঠেছে আজ মোটে চারদিন। পায়ের ফোলা কমে নি। তুমি না বাঁচালে কেউ বাঁচাতে পারবে না।)
এ অবস্থার জন্য ছদু তৈরি ছিলো না। হাসিমকে কানে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে এসেছিলো। পদতলে শায়িতা রোরুদ্যমানা রমণীর আকুতিতে তার ভেতর একটু করুণার সঞ্চার হলো। মনের দৃঢ় সংকল্প কেমন যেন নেতিয়ে পড়লো। ভাবে, মোটাসোটা হলে কি হবে, বান্যার জাত তো। বাপের আমলে মুসলমান হয়েছে। রক্তে হিম্মত না থাকারই কথা। খুন-খারাপীকে জব্বর ডরায়। হাতের লাঠিটা ঘুরিয়ে হাসিমকে একটা বাড়ি দিয়ে বৃথা সময় নষ্ট না করে চলে গেলো।
খলু মাতব্বরের বৈঠকখানা ঘরে আট-দশজন মৌলানা সুর করে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করে। দাঙ্গা শেষ না হওয়া পর্যন্ত করতে থাকবে। মেয়েরা হাতের খাড় এবং নাকের নাকফুল খুলে ফেলেছে। তারা রাড়ীর বেশ ধারণ করেছে। স্বামী-পুত্র যদি আর ফিরে না আসে। লেঠেলরা কলেমা পাঠ করে। লাল পাগড়ী পরা মানুষগুলো ‘আলী আলী’ রব তুলে লাঠি বর্ষা হাতে বরগুইনির চরে যাত্রা করলো।
ঠিক জোহরের নামাজের পরে তারা রক্তাক্ত কলেবরে ফিরে এলো। অনেকেই আহত। কারো মাথা ফেটে গেছে, হাত ভেঙ্গেছে কারো। মাতব্বরের ছেলে আবদুল চোখ খুলতে পারছে না। তারে চোখের ভেতরে কাদির মিয়ার লোকদের ছড়ানো মরিচের গুঁড়ো ঢুকেছে। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, অস্থির যন্ত্রণায় নাচানাচি করছে। মাতব্বরের বাহুমূল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। সবচেয়ে বেশি চোট লেগেছে ছদুর। বিপক্ষ দলের মানুষেরা তাকে ঠেঙিয়ে সংজ্ঞাহীন করে ফেলেছে। গ্রামের সবচেয়ে সবল যুবা, সবচেয়ে দুঃসাহসী, গ্রামের মান-ইজ্জতের সঙ্গে শিরার শোণিত-কণিকার অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ ছিলো যার– সে ছদুকে মারতে মারতে সংজ্ঞাহীন করে ফেলেছে; সে-ই তো প্রথমে বিপক্ষ দলকে পেছনে ঘুরে আক্রমণ করেছিলে। একজনকে বর্শার ঘায়ে উরুর কাছটিতে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলেছিলো। ছদুর পেছন পেছন গাছবাড়িয়ার ওরা গিয়ে বিপক্ষ দলের ওপর এলোপাতাড়ি মার শুরু করেছিলো। সহ্য করতে না পেরে তারা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছে। ছদু টেকে বাঁকে বর্শা হাতে তাদের পেছন দিক থেকে তাড়া করতে করতে যখন বরগুইনির পানিতে এসে নেমেছে তখনই তারা সুযোগ পেয়ে চলে গেলো। একটু পানি নাকি চেয়েছিলো। কে একজন মুতে তাকে পান করতে দিয়েছে। কে কাকে দেখে, সকলেই আহত। লেগেছে সকলের। মা-বোন স্ত্রী পুত্র লক্ষ্য করেছে। খলু মাতব্বরের উঠোনে চ্যাংদোলা করে এনে রেখেছে ছদুকে। খালের পানির মতো রক্ত ছুটছে বলকে বলকে। হাফেজ ডাক্তার প্রাণপণ চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারছে না।