“হালার পুত কাদিরা।”–(শালার পুত কাদিরা–)।
কাঁচা ছেলে খলু নয়। লাঠিতে হলে আসো। মামলা-মোকদ্দমা করে ভদ্রলোকের পরিচয় দিতে চাও–সেও আসো। খলু পথের ভিখারী নয়। মাথায় বুদ্ধি, গাঁটে কড়ি–দুই-ই তার আছে। গোলায় এখনো চার বছরের বিন্নি চিকন ধান মজুত আছে। যে ভাবেই যুদ্ধ করতে চাও, আসো। খলু পিছু হঠার মতো মানুষ নয়। কোনো জিনিসে নজর দিয়ে পিছু হটে না খলু কোনোদিন। মরদের মতো জান বাড়িয়ে লড়তে জানে।
“তুমি খড়গ ধারিলে আমি খৰ্গধারী
তুমি যদি পুরুষ হও আমি ই নারী।”
পুঁথির মজলিসে শোনা পদ্মাবতীর কাহিনীর রাজা রত্নসেনের উক্তিটি মনে মনে কয়েকবার আওড়ালো। সবকিছু ঠিকঠাক। বিধাতার অন্তরের গোপন আকাঙ্খার মতো নিখুঁত পরিকল্পনা খলুর। তবু মনের ভেতরে একটা সংশয় দোলা দিয়ে যায়। ভবিষ্যতকে কিসের বিশ্বাস। খলুর মতো অমন ধড়িবাজ মানুষও আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে পায়চারী করে। মাথার তালুতে উত্তাপ জমে।
দু’চারদিন পর দু’গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো প্রবল সংক্রামক উত্তেজনা। ডরে এ গ্রামের মানুষ ও গ্রামের ওপর দিয়ে যায় না। মাতব্বরের ভাতিজা রমজু এসবের কিছু জানে না। সে বরকল গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে ঘরজামাই থাকে। বাপের ভিটেতে সাতবাড়িয়ার ওপর দিয়ে বেড়াতে আসার সময়, সাতবাড়িয়ার মানুষ মেরে আধমরা করে দিয়েছে। রমজুর সঙ্গে খলুর সদ্ভাব ছিলো না। খলু ভেবেছিলো ভাতিজা নাম মাত্র দামে ভিটেটুকু কবলা করে দেবে চাচাকে। রমজু কিন্তু উচিত দামে জাহেদ বকসুর কাছেই ভিটে বেচে খাল কেটে কুমীর এনে দিলো। অন্য কেউ হলে বেদখল করে দিতে। জাহেদ বকসুরা পাঁচ ভাই আর গ্রামের নতুন ধনী। খলুর জারিজুরি চালাকী তাদের কাছে চলবে না। বাধ্য হয়েই চুপ করে রইলো। কিন্তু আজকে কাদির মিয়ার মানুষের হাতে বেদম মার খাওয়া ভাতিজার জন্য খলুর দরদ উথলে উঠলো। পাড়ার লোকে দূর ভিন গ্রামে চলে গেলেও রমজুকে ভালোবাসে। এ সুযোগেই খলু গ্রামের লোককে এক জায়গায় জড়ো করলো। গ্রামের দশজনকে ডেকে এনে ঘটনাটা সবিস্তারে বর্ণনা করলো। ছতুর বাপ, কানা আফজল, ফয়েজ মস্তান সকলে এসেছে। আর এলো গ্রামের যুবকেরা… যাদের লেঠেল রক্ত ছলকে ছলকে গরম হয়ে যায়। এ কথা সে-কথা… কাদির মিয়াকে খুব এক চোট গালাগাল দেওয়ার পর সকলে মূল কথা আলোচনা করতে লাগলো। কিভাবে এ অন্যায়ের বদলা নেয়া যায়। এ বদলা নিলে গ্রামের ইজ্জত হুরমত বজায় থাকে না। কুয়ত কি শুধু তাদের বাহুতে? হিম্মত কি শুধু তাদের বুকে? গাছবাড়িয়ার যুবকেরা কি মরে গেছে? তাদের লহু কি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে? তারা কি শোধ নিতে জানে না? ছতুর বাপ দু’হাতে দাঁড়ি মুঠো করে একাধিক দাঙ্গার কথা বললো। সে সকল দাঙ্গায় সাতবাড়িয়ার মানুষ কি মার খেয়েছিলো, সে কথাও বললো। কানা আফজল আশ্বাস দিলো। ওসব কাজে বুকে হিম্মত আর মাথা ঠিক রেখে ঘাড়ে দায়িত্ব নিতে হয়। সে আশ্বাসে গ্রামের যুবকদের রক্ত চাড়া দিয়ে ওঠে। প্রতিশোধের নেশায় তারা পাগল হয়ে যায়। গ্রামের সব চাইতে শক্তিমান, সেরা দাঙ্গাবাজ যুবক ছদু মন্তব্য করলোঃ।
“আঁরা কাদিরা চোরার নাহান চুরি গরি মাইরতাম নয়। খবর দেও। সামনাসামনি দাঙ্গা গইরগম–তারপর খানকীর পুতের মাথা কাডি লইয়ম।” (আমরা কাদিরা চোরার মতো চুরি করে মারবো না। খবর দাও, সামনাসামনি দাঙ্গা করবো। তারপর খানকীর বাচ্চার মাথা কেটে নেবো।)
স্থির হলো সামনাসামনি দাঙ্গা করার জন্য কাদির মিয়াকে খবর দেওয়া হবে । দু’পক্ষে যথারীতি খবর চালাচালি হয়ে গেলো। আগামী সোমবার দাঙ্গার দিন ধার্য হয়েছে। দু’দিন ধরে সারা গ্রামের কারো চোখে ঘুম নেই। কিরীচ শানাচ্ছে। কামার বাড়িতে পিটিয়ে বর্শার মুখ ছুঁচলো করে আনছে। মেয়েরা রাত জেগে কেঁকিতে পাড় দিয়ে মরিচের মিহি গুঁড়ো তৈরি করছে। বাঁশ ঝাড় থেকে লাঠি কেটে জুতসই করছে। খলুর মেটে দেওয়ালের বৈঠকখানায় দিনে-রাতে মিটিং চলছে। নতুন নতুন পরামর্শ হচ্ছে। কৌশলের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। রোববার দিন বিকালবেলা খলুর বড়ো ছেলে হাজারী হাটে গিয়ে একটা গোটা গরুর গোশত্ কিনে নিয়ে এলো। আগামীকাল দাঙ্গা করতে যাবার আগে লেঠেলদেরকে গোশত্ দিয়ে ভাত খাওয়াবে।
রাতে খলুর বৈঠকখানায় চাপা আলোচনা চলছে। মনির আহমদ, হিমাংশু ধর, মান্নান প্রভৃতি চার-পাঁচজন মাতব্বরকে ডাকতে ডাকতে বৈঠকখানায় এলো। এরা কৃষক সমিতির মানুষ। দেখে মাতব্বর স্পষ্টত বিরক্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তারা সদলবলে এসেছে। এই কৃষক-সমিতিই মাতব্বরের লাভজনক বহু অভিসন্ধিকে ভণ্ডুল করে দিয়েছে। মফিজার মার ভিটাটুকু বলতে গেলে খলু একরকম পানির দামেই কিনে নিয়েছিলো। কিন্তু মনির আহমদই চাঁদা তুলে মফিজার মা’র মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। ফলে চৌদ্দশতক অমন ফলন্ত সুপুরির বাগান নিজ দখলে আসি আসি করেও এলো না। মাথা খাঁটিয়ে কিছু লাভের কাজ করতে চাইলে পারে না। এরা কোত্থেকে এসে বাধা দেয়। শহর-বন্দর চেনে। আইন-আদালত বোঝে। পত্রিকার কাগজে কি সব লেখালেখি করে। কিছুদিন আগে ওপরে টিপসই দিয়ে দরখাস্ত পাঠিয়ে খাসমহালের তহশীলদারকে জেলে পাঠিয়েছে। লোকটা একদম বিনামূল্যে চরের দু’পাশের জমি বন্দোবস্ত দিতে চেয়েছিলো। বাতির স্বল্প আলোকে মনির আহমদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাবখানা জেনে নিতে চেষ্টা করে। মনির আহমদ কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললোঃ