“না, আর জমি মোড়া ধানর। ক্যারে চিয়ন ধানর চাষ গইরতাম দিতাম নয়।” (না, আমার জমিন মোটা ধানের, কাউকে চিকন ধানের চাষ করতে দেবো না।)
চোখের পলকের মধ্যে একেবারে আগের হালের সামনে জলকাদার ওপর শুয়ে পড়লো। আগের হালের পেছনে লাঙলের গুটি ধরে আসছিলো খলু মাতব্বর। ঘটনার আকস্মিকতায় সুলতানসহ সকলে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ালেন। খলুর এতে ভাবান্তর নেই। পলিমাটির বুক চিরে চিরবিরিয়ে লাঙল টেনে, দুর্ধর্ষ ষাড় জোড়া ঘার বাঁকিয়ে পলটনের ঘোড়ার মতো চলছে। গতির মুখে বুড়োকে শায়িত দেখে কালো গরুটা গলা নীচু করে বুড়োর ঘাড়ের নীচে লম্বা শিং দিয়ে একটা ঘাই দিলো। বুড়ো ‘মা রে বাপরে’ বলে উঠে দাঁড়াতে পিঠের ঝুলে পড়া চামড়ায় তীক্ষ্ণ বাঁকা দীর্ঘ শিং ঢুকিয়ে দিলো। বুড়োর শরীরের শাদাটে মাংস বেরিয়ে পড়লো। কয়েক বিন্দু রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরতে থাকে। খলু বলে সুলতানকেঃ
“ভাইপুত, এই বেকুবরে পাথারি কোলা গরি রাস্তার উয়র রাখি আয়।” (ভাতিজা, এই বেকুবকে পাঁজাকোলে করে, রাস্তার উপর রেখে এসো।)
সুলতান বুড়োকে পাঁজাকোলো করে রাস্তার ওপর রেখে আসে। বুড়োর পিঠ এবং ঘাড় থেকে সুলতানের হাতে, গেঞ্জিতে ও লুঙ্গিতে রক্ত লাগে। রক্তাক্ত হাতে মুখ মুছে। ছোপ ছোপ রক্ত লাগে মুখে। খুনীর মতো দেখায় সুলতানকে। কবীরের বাপ কঁকায়। কঁকিয়ে আল্লাহর আরশের উদ্দেশ্যে বলেঃ
“আল্লাহ্ আঁর বোবা পুত, আঁর বোবা ছাওয়াল।” (আমার বোবা ছেলে।)
বুড়োর কথা কওয়া ছেলেকে যম নিয়ে গেছে। আরেকটি বোবা ছাওয়াল ছিলো। কথা কয় না। চাহিদা মতো ধান দিতো, মরিচ দিতো। কালো হীরে মাটি তার বোবা ছাওয়াল। বুড়ো হাড়ের সর্বশক্তি দিয়ে বোবা ছাওয়ালকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু পারে নি। ঘাড়ের কাছে রক্ত, পিঠে রক্ত, বুকের ক্ষত চুঁইয়েও বুকের ভেতর ঝরছে রক্ত। তবু বুড়ো চীৎকার করেঃ
“আল্লাহ্, আঁর বোবা ছাঁওয়াল।”
এক চাষ দেয়া হয়ে গেলে গরুকে জোয়ালমুক্ত করে হাল লাঙল কাঁধে ফেলে লেঠেলদের নিয়ে চলে গেলো খলু।
কয়েকটা দিন পার হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটে নি। বরগুইনির পাড়ের পাশাপাশি দুটো গ্রাম কেমন ঝিম্ মেরে আছে। অথচ এ নীরবতার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে কুটিল একটা চক্রান্ত। সাত বাড়িয়ার মানুষ ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিতে পারবে না, খলু মাতব্বর আগেই সে আশঙ্কা করেছিলো। তবু পুরোপুরি ওয়াকেবহাল হবার জন্যে খলু মাতব্বর মকবুল মস্তানের ছেলে ফয়েজ মস্তানকে মাগুর মাছের মাথা আর লক্ষীবিলাস চালের গরম ভাত বেঁধে খাইয়ে আসল খবর সংগ্রহ করার জন্যে সাতবাড়িয়া পাঠিয়ে দিলো।
ফয়েজ মস্তান মানুষ। সুতরাং তার পথ অটকায় কে? এককালে অনেকেই তার বাপের মুরীদ ছিলো। পীর মুর্শীদের প্রতি টান উঠে গেলেও অনেকে ফয়েজকে এখনো সমীহ করে। অবশ্য তারা বুড়োবুড়ি। হাল জমানার চ্যাংড়ারা ফয়েজকে পরোয়া করে না।
সন্ধ্যাবেলায় ফয়েজ খবর দিয়ে গেলো। মাগুর মাছের মাথা এবং চিকন চালের ভাতে বেশ কাজ দিয়েছে। ফয়েজ এক্কেবারে পাকা খবর দিয়ে গেছে।
গেলো ফাল্গনের আগের ফাল্গনে গরুর লড়াইয়ে কাদির মিয়ার ছেলের সঙ্গে মাতব্বরের ছেলের মারামারি হয়েছিলো। কাদির মিয়ার গরুর সঙ্গে গরুর লড়াই দিয়েছিলো চৌধুরী পাড়ার খোলায়। মাতব্বরের গরু আঁটতে না পেরে হেঁটে যাচ্ছিলো। আরেকটু হলেই হটে যেতো। নিজের গরুকে পরাজিত হতে দেখে মাতব্বরের ছেলে আবদুল বেপরোয়াভাবে কাদির মিয়ারটাকে কেরেক বেত দিয়ে মারতে থাকে। কাদির মিয়ার ছেলেও রেগে তেড়ে এসে আবদুলকে মেরেছিলো। দু’দলে লাগলো দাঙ্গা। কাদির মিয়ার ছেলেরা সংখ্যায় বেশি ছিলো না। তাই একেবারে ঘেঁচে পানি করে দিয়েছিলো। গরু কেড়ে রেখেছিলো। খলুর ছেলের কাছে তার ছেলে মার খেয়েছে একথা হাকিমের কাছে স্বীকার করতে হবে, সে বড় লজ্জার কথা। সে জন্যে কাদির মিয়া মামলা করেনি। নীরবে নীরবে সুযোগের সন্ধান করছিলো। এতদিন পরে সুযোগ মিলেছে।
খলুকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যে বিনামার তারিখের আগের স্ট্যাম্প কালোবাজার থেকে যোগাড় করে সদর রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে কবীরের বাপের সে তিনকানি জমি আগের তারিখ দিয়ে কবলা করে নিয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক করে ওঁত পেতে বসে আছে। বাপ বেটাকে পেলে একসঙ্গে কেটে কুচি কুচি করে বরগুইনির পানিতে ভাসিয়ে দেবে।
খবর পেয়ে খলু তড়িঘড়ি কাজীদের বড় পুকুরে মাছ ধরতে জাল নামিয়ে দেয়। খলু পুকুরটা দু’বছর আগে খাসমহাল থেকে পানির দামে নীলামে খরিদ করেছে। দুটো বড় কাতলা মাছ ধরে। ঘর থেকে সরু কমল চিকন চাল, সে অনুপাতে তেল ডাল তরকারী দিয়ে একটা মাছ তহশীলদার সাহেবের বাসায় এবং অন্যটা পাঠিয়ে দেয় কানা আফজলের বাড়ি। এককালের কাজী রহমতের ভাবশিষ্য এবং দুষ্কর্মের সঙ্গী কানা আফজল বর্তমানে আফজল আহমদ চৌধুরী। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
তহশীলদার যদি খাসমহলের কাগজপত্রে সবকিছু ঠিক করে রাখে, কাদিরার বাপের কি সাধ্য তাকে বেদখল করে। তবু আসতে পারে আপদ-বিপদ। সেজন্য বুদ্ধি করে চেয়ারম্যান কানা আফজলের মুখ বন্ধ করে রাখলো। মেম্বার চেয়ারম্যান পক্ষে থাকাটা খুব ভাগ্যের কথা। বিপক্ষে গেলে রক্ষে নেই। ডালি না পেলে, জানা কথা, বিপক্ষে যাবে। শালারা গুখোরের জাত। মার কানের সোনা চুরি করতে কসুর করে না। পাঁঠাপাঠির ভেদ তাদের কমই আছে। গ্রামের মানুষদেরকেও স্ববশ করেছে। ছতুর বাপ মুসুল্লী মানুষ, তার কথা দশজনে শোনে, মান্য করে। দাওয়াত করে গলা পর্যন্ত আছুদা করে খাইয়েছে। এখন পষ্টাপষ্টি বলে ছতুর বাপ। বিনামা নেই শরীয়ত মতে… বিনামা মানেই কবলা। জোহরার কাছে সাফ-কবলা দিয়ে বেচে দিয়েছে কবীরের বাপ। জোহরার হক… সে তিনকানি সম্পত্তি। বর্তমানে মাতব্বর জোহরার গার্জিয়ান…। সুতরাং খলু মাতব্বরের ও জমিতে হাল চষতে শরীয়তের কোন বাধা নেই। কেউ বেদখল করতে চেষ্টা করলে গোটা গাঁয়েরই বেইজ্জতি। মুর্গীর রান খেয়ে ছতুর বাপের মুখ দিয়ে এখন জজবা ছুটছে। আপাতত তসবীহ টেপা বন্ধ রেখে কবীরের জমি যে খলু মাতব্বরের হক যত্র তত্র সে কথা প্রচার করে বেড়াচ্ছে। মকবুল মস্তানের ছেলে ফয়েজ মস্তান। সে তো বলতে গেলে, ঘরের কুত্তা-বিলাইর সামিল। তু তু করে ডাকলে এসে লেজ নাড়বে, হেই বললে চলে যাবে। আগে দু’বেলা আদালতে মিছা সাক্ষী দিয়েও পেটের ভাত যোগার করতে পারতো না। খলু-ই তো একক প্রচেষ্টায় মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন দুই-ই করেছে। তাকে। এখন যে গায়ে লম্বা কোর্তা ঝুলায়, চেহারায় যে জৌলুস বেড়েছে, দু’দুটো বিয়ে করেছে-এর মূলে কি খলু মাতব্বর নয়? ঠোঁট বেয়ে একটা লতানো হাসি জাগে এক সময়ে। সশব্দে উচ্চারণ করেঃ