তার পরের দিন খলু মাতব্বর তিন ছেলেসহ বরগুইনির দক্ষিণ পাড়ের বিলে হাল জোতে। সূর্য ওঠার অনেক আগেই বাপ-বেটা তিনজনে হাল জুতেছে। সাধারণত এতো রাতে কেউ হাল জোতে না। দিনের আলোতে সাহস করেনি। তাদের দেখে মানুষের চোখে যে জিজ্ঞাসার চিহ্ন জাগবে তার কোনো সঙ্গত জবাব দিতে পারবে না বলেই বোধ হয় রাতের অন্ধকারে পরের জমিতে, পরের অধিকারে হাল চালাতে এসেছে। পূবের আকাশে শুকতারাটি দপদপিয়ে জ্বলছে। মাতব্বরের তিনটি হালের ছ’টা গরু থলো থলো পানির ভেতর পাক খেয়ে হাঁটছে। পানিতে ছলাৎ ছলাৎ জাতীয় আওয়াজ ফেটে পড়ছে। রোশন আলী যাচ্ছিলো শহরে। প্রতিদিন তরকারীর টুকরী মাথায় করে সকাল সাড়ে চারটার গাড়ী ধরে। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় পানির আওয়াজ এবং গরু ফেরাবার বোল শুনতে পেয়ে কৌতূহল জাগে রোশনের। তরকারীর টুকরীটাসহ হেঁটে হেঁটে আলের ওপর দিয়ে কবীরের বাপের তিন কানি চরের আলের কাছে এসে থামে। কাঁচা কর্দমাক্ত আলের ওপর মাথার টুকরিটা নামিয়ে রাখে। বাপ-বেটা তিনজনে নিঃশব্দে গরু ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারো মুখে রা নেই। আচাবুয়ার মতো দেখায় একেক জনকে। রোশন আলী হাঁ করে চেয়ে থাকে। কবীর মরেছে আজো বিশদিন হয়নি। খলু তামাক পাতার একটা মোটা চুরুট টানছে। সে আগুনে তার শয়তানের মতো মুখখানা দেখা যায়। হাল নিয়ে আলের এদিকে এলে কেউটে সাপের মতো কুতকুতে চোখে রোশন আলীকে দেখে ।
আর শহরে যায় না রোশন আলী। কাঁচা আল থেকে প্যাক মাখা টুকরিটা মাথায় তুলে নিয়ে ঝপ ঝপ করে পানি ভেঙে চলে আসে। কিছুদূর এলে তার কানে খলুর কণ্ঠস্বর আঘাত করেঃ
“মেডি আর বেডি তার, জোর আছে যার।” (মেয়ে মানুষ আর মাটি তার যার জোর আছে।)।
সাতবাড়িয়ায় রোশন আলীর বাড়ী। জমিনের গোড়া থেকে প্রায় আধ মাইল দূর। গ্রামে পৌঁছে লোকজনকে খবরটা জানায়। সদ্য পুত্রশোকে কাতর কবীরের বাপকে কেউ খবরটা দিতে সাহস করে না। তাই বুড়ো সংবাদ পেতে পেতে আকাশে সূর্য ওঠে। পড়ি মরি জ্ঞান না করে ষাট বছরের বুড়ো দুর্বল শরীর নিয়ে লাঠি ভর করে হাঁটতে থাকে। ডানে বামে না চেয়ে এক নাগাড়ে কিসের ওপর দিয়ে হেঁটে এলো সে হুঁশ নেই। তিন কানির চারদিকে পথের মতো বড়ো আলের ওপর এসে বসলো। খলু আর তার ছেলেরা বুড়োর দিকে একবারও ফিরে তাকালো না পর্যন্ত। নির্বিকারভাবে গরু খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক রাতে হাল জুতেছে। প্রায় এক চাষ দেয়া হয়ে গেলো। জোয়ান গরু, জোয়ান মানুষ। চন্দ্রপুলী পিঠের মতো স্তরে স্তরে পলিময় মাটি। ধারালো তিনখানা লাঙলের কতোক্ষণ লাগে।
বুড়োর ছেলে গেছে। ছেলের বউ গেছে, জমিটাও যেতে বসেছে। আলের ওপর বসে অনেক কথাই মনে পড়লো। সে বছর তিলের বেপার করতে শঙ্খ উজান গিয়েছিলো। উজানের উঁচু পাহাড়ে ওঠবার সময় গড়িয়ে নীচে পড়ে যেতে যেতে শিমুল গাছের শেকড় ধরে আত্মরক্ষা করেছিলো। বুকের কাছে চোট লেগেছিলো। পনেরো দিন বিছানা থেকে উঠতে পারে নি। সে বছরই তিল বেপারের লাভের টাকা দিয়ে এ জমি কিনেছিলো হরিদাস মহাজনের ছেলের কাছ থেকে। তারপরে আর কোনোদিন উজানে বেপারে করতে যায়নি। এ জমিতে চাষ করেছে। ফলিয়েছে ফসল। ধান বেচে টাকা জমিয়ে বিয়ে করেছে। তরমুজ বেচে সোনার নাকফুল কিনে দিয়েছে বৗকে। ছেলে হয়েছে। ছেলে বড়ো হয়েছে। গায়ে কাঁচা সোনার মতো রঙ হয়েছে। চাষী গেরোস্তের ঘরে অমন সুন্দর গায়ের রঙ সচরাচর দেখা যায় না। ছেলেকে বিয়ে করিয়েছে। ছেলের বউ এসেছে, বেঁধেবেড়ে খাইয়েছে। অজু করবার পানিভরা বদনা এগিয়ে দিয়েছে। শাশুড়ীকে প্রাণপণ সেবা করেছে। ছেলের মা মারা গেলো। সে সময়ও তরমুজ বেচা পয়সায় কেনা সোনার নাকফুলটা জ্বলজ্বল করছিলো নাকে। তারপর ছেলের বউও গেলো। তারপর… বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ হয়। বুকের ভেতর জলোচ্ছ্বাস জাগে, বুকের তলায় আগুন জ্বলে। ছোটো ছোটো কোটরাগত চোখ দুটোর চার পাশে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে… জমতে থাকে। জমাট শিশিরে আকাশ পৃথিবী ছেয়ে যায়। বুড়ো কিছু দেখতে পায় না। স্থাণুর মতো কাঁচা আলের ওপর লেপ্টে বসে আছে। দুঃখ আর বয়সের ভারে পৃথিবী তখন সেঁধিয়ে যাচ্ছে বুঝি মাটির ভেতর।
“চাচা, কি ধান দিবা?” ছতুর বাপের বড়ো ছেলে সুলতান, পেছনে আরো দশ বারোজন লেঠেলসহ এসে জিজ্ঞেস করে। সকলের হাতে লাঠি। সাতবাড়িয়ার মানুষ খলুকে জমি চষতে বাধা দিতে পারে। সে আশঙ্কা করে সুলতান লাঠিসোটা আর সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে এসেছে। কবীরের বাপ সুলতানের কথায় জ্ঞান ফিরে পায়। কি দেখছে? কি ভাবছে? তেজী গরু সিনা আলগা করে পানির ওপর ঝপঝপিয়ে হাঁটছে। লাঠি হাতে অনেক মানুষ দাঁড়ানো। ওদের চোখে মুখে ক্রুরতা! সকালের শিশু সূর্য লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠছে।
“ভাইপুত চিন্নাল ধান দিয়ম। কেন অইব?” [ভাতিজা ভাবছি চিন্নাল ধান (এক রকমের ধানের নাম) দেবো। কেমন হবে? জানতে চায় সুলতানের মতামত। সুলতান মাথা নেড়ে জবাব দেয়ঃ
“ছোডো ধান খুব ভালা অইব চাচা।” (হা, সরু ধান খুব ভালো হবে চাচা!)
হঠাৎ কবীরের বাপ গোত্তা খাওয়া বাঘের মতো ফুঁসে ওঠে। চোখের চারপাশ থেকে বিন্দু বিন্দু শিশির অন্তর্হিত হয়ে যায়। গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ায়। তার নিজের অধিকারের ওপর হাত দিয়েছে। যতোই দুর্বল হোক সে, সহ্য করবে না।