কাজী পরিবারের বাদীর গর্ভে সে জন্মলাভ করেছে। এ কথা কেউ যেন তাকে ভুলতে দেবে না। এমন কি, যে গোলাম কাদের বুড়ো তাকে একটু খাতির করে, বানিয়ার পুত বলে না, হাসিম বলে ডাকে– সেও এ ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছে। কাজী বাড়ির গৌরব, প্রভাব প্রতিপত্তি সবকিছুর বিরুদ্ধে তার মনে ধারালো বিদ্বেষ রেখায়িত হয়। বুড়ো হরদম ঘ্যানর ঘ্যানর করে। হাসিম দেখতে পায়, একটা করুণ বিষাদময় আলেখ্য, যার সঙ্গে তার জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে এবং জড়িয়ে যাবে তার উত্তর-পুরুষের জীবন। বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো, চোখ মেলে দেখে বুড়োর চোখে পানি। হাসিমের মনটা গলে যায়। একটু আগের বিদ্বেষ করুণার বিগলিত ধারায় বুক ছেয়ে যায়। লজ্জিত হয়ে গোলাম কাঁদেরের দিকে মনোনিবেশ করে।
“হাসিম, তুই ক’ বাই। আঁই কি কনদিন কেউর কেচা আইলত পারা দিই-না পনা (পাকা) ধানেত মই দিই? পুত নাই, পৈতা নাই, মাইনসে আঁরে এত কিল্লাই বেইজ্জত গরে?” (হাসিম ভাই, তুমি বলো দেখি। আমি কারো কাঁচা আলে পা দিয়েছি, না পাকা ধানে মই দিয়েছি? ছেলে-পুলে নেই, তবু মানুষ আমাকে এতো বেইজ্জত কেন করে?)
হাসিম স্তব্ধ হয়ে মুখের দিকে চেয়ে থাকে। বুড়ো একটু একটু করে সবকিছু বর্ণনা করে। আজ দুপুরে চন্দনাইশের একজন লোক ছাগির দড়ি ধরে পাঁঠার খোঁজ করছিলো। খলু নাকি বলেছে গোলাম কাঁদেরের একটা জাতি পাঁঠা আছে। খলুর কথা বিশ্বাস করে গোলাম কাঁদেরের কাছে গিয়ে বলেছে, আপনার কাছে নাকি একটা জাতি পাঠা আছে। আমার ছাগিটা তিনদিন ধরে ডাকছে। দূরে যেতে হলো না, ভাগ্য ভালো। দয়া করে আপনার পাঁঠাটা একটু দেবেন কি? বাচ্চা দিলে আপনাকে দুধ দিয়ে যাবো। কাজী গোলাম কাদের বেদম খেপেছিলোঃ
“আর কাছে পড়া আছে বুলি তোরে কন্ কুত্তার বাইচ্চায় কইয়েদে?” (আমার কাছে পাঠা আছে, এ কথা তোমাকে কোন্ কুত্তার বাচ্চা বলেছে?)
কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা। খলু বলে দিয়েছে, পাঁঠা চাইলে বুড়ো প্রথমে দা। হাতে কাটতে আসবে। তাতে বেজার হওয়ার কিছু নেই। মুখটা খারাপ হলেও বুড়োর মনটা ভালো। এক সময় হাসি মুখে পাঁঠা দিয়ে তোর কাজ উদ্ধার করে দেবে। বুড়োকে নাজেহাল করার জন্যে খলু মাঝে মাঝে এ ধরনের ইতরামমা করে থাকে। কেউ কিছু কিনতে এলে ক্রেতাকে বুড়োর কাছে পাঠায়। এ করে খলু এক ধরনের আনন্দ পায়। এরকমভাবে লজ্জা দিয়ে কাজী বাড়ীর সাত পুরুষের ঐতিহ্যে আঁচড় কামড় কাটে।
চোখের অনেক পানি ঝরে গেলেও শান্ত হয় না বুড়ো। বুকে আগুন জ্বলছে। শরীরের বল থাকলে খলুকে রসাতল করে ফেলতো। তার অভিশাপে ফল ফলবে না, দম্ভে কোনো কাজ দেবে না, এ কথা বুড়ো জানে– হাড়ে হাড়ে জানে। তারপর হাসিমকে একেবারে কাছে ডেকে গোপন কোনো পরামর্শ করেছে, তেমনি ফিসফিসিয়ে খলুর নতুন কাণ্ড-কাহিনীর কেচ্ছা শোনায় সবিস্তারে। শুনে হাসিম চমকে ওঠে না। গোড়াতেই আঁচ করেছিলো। কেননা জোহরার তালাক দেয়া স্বামী কবীর এখন বেঁচে নেই। তিন কানি ধানি জমি নিজের চাষে নিয়ে আসার পথে মাতব্বরের কোনো বাধা নেই। বুড়ো এবার তার দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রভ চোখের দৃষ্টিরেখা বাগিয়ে ধরে। ত্রিকালদর্শী বিচারকের মতো মন্তব্য করলোঃ
“দেখিস হাসিম, এইবার হারামির পুত মরিব। পরের হক নয়, মরণের দারু কানত বাইন্ধ্যে। পরের ধন হরণে গতি নাই মরণে।” (দেখিস হাসিম, এবার হারামির ছেলে মরবে। পরের হক নয়, কানে মরণের ওষুধ বেঁধেছে।)
সৃষ্টির পরম সত্যটির মতো বুড়ো কথা বললো। কথা বলে খুশি হলো।
সেদিন সন্ধ্যায় দোকানে গিয়েও এ আলোচনা শুনতে পেলো। এ জমি মাতব্বরের দখল করা উচিত, সে সম্পর্কে মতও দিলো অনেকে। ছতুর বাপের বড়ো ছেলে সুলতান বললোঃ
“এই জমিনত যেই ধান পাইব, হেই ধানদি মাতব্বরের বিরাট জেয়াফত দিব, তিন বেলা খাবাইব। দুইটা গরু দিব আল্লাহর নামে।” (এই জমিতে যে ধান পাওয়া যাবে, তাই দিয়ে মাতব্বর বিরাট নেমন্তন্নের আয়োজন করবে। তিন বেলা খাওয়াবে। আল্লাহ্র নামে দুটো গরু জবাই করবে।)
জেয়াফত এবং তিন বেলা খাওয়ার নামে অনেক প্রতিবাদী কণ্ঠ নীরব হয়ে গেলো। তবু কয়েকজনের মনে খুঁতখুঁতানি রয়ে গেলো। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চিকিৎসা করে যোগী পাড়ার সুধীর। অনেককে সুধীরের কাছে ঠেকতে হয়, অনেক সময় চিকিৎসা করিয়ে পয়সা দিতে পারে না। পয়সা ছাড়াও চিকিৎসা করতে পারে বলে সুধীরের জিহ্বার ধারটা কিঞ্চিত বেশি। হক কথা বলতে বাপকেও ভয় করে না। সুধীর বলেঃ
“গরু জবাই গরিল ভালা কথা, জেয়াফত দিল ভালা কথা, পাড়ার মাইনসরে খাবাইল, আরও ভালা কথা। কিন্তু পরের জমিনের ধান দিয়ে রে ক্যা?” (গরু জবাই করলো ভালো কথা, নিমন্ত্রণ দিলো ভালো কথা। পাড়ার লোককে খাওয়ালো, আরো ভালো কথা, কিন্তু পরের জমির ধান দিয়ে কেন?)
“ন বুঝিলা না, বৈদ্যের পুত নিজের জমিনের ধান বেচি মাইনসে টেঁয়া কামায়। পরের জমিনের ধানদি ছোঁয়াব কামায়।” (বুঝলে না বৈদ্যের পুত, নিজের জমির ধান বেচে টাকা জমায়, পরের জমিনের ধান দিয়ে পূণ্য সঞ্চয় করে।)
সুধীরের কথার জবাব দেয় লেদু। তারপর একটু হেসে ওঠে। মাতব্বরের ছোটো ছেলে সুলতানকে বাপের নাম করে ডেকে নিয়ে যায়। তসবীহ্ টিপতে টিপতে ছতুর বাপ ঘরে ঢুকে নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করে।