“হেইভা কন?” (সেটা কে?)।
“ওডি আগে তোল আঁরে কেঁড়ায় খাই ফেলাইল। উহ্ বাবারে মরি গেলাম রে।” (ওগো, আগে তো আমাকে কাঁটায় খেয়ে ফেললো। উঃ বাবা গো, মারা গেলাম।) ক্লিষ্ট কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসে।
বুড়ীকে পাড়ে টেনে তুলে কাপড়ের কাঁটা বাছতে বাছতে জিজ্ঞেস করে সুফিয়াঃ
“দাদী তুই ঝাড়ত ক্যা পইরলা?” (দাদী, তুমি ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেলে কেমন করে?)
“অধর, অধর গেলদে রাস্তাদি।” (অধর, অধর যে গেলো রাস্তা দিয়ে।) বুড়ী বিজ্ঞতার ভান করে মাড়ি দেখিয়ে হাসে।
সুফিয়ার আর বোঝার বাকি থাকে না। বুড়ীকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। চালের পুঁটুলিটা হাসিমের সামনে রাখে। ঘরের ভেতরে ঢুকে সর্ষের তেলের বোতলটা এনে উপুর করে বুড়ীর ছড়ে যাওয়া কুঁচকানো চামড়ায় লাগায়। যন্ত্রনায় উঁহু হু করে বুড়ী।
স্বল্পালোকিত বাতির স্লান শিখায় হাসিমের রোগা-পাণ্ডুর কষ্টক্লিন্ন মুখ দেখতে পেয়ে নিজের যন্ত্রনার কথা ভুলে যায়। করুণায়, সেহে, দুঃখে অন্তরের গহনতল পর্যন্ত আলোড়িত হয়। পাশে উবু হয়ে বসে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখে।
“সোনা কন জাগাত জখম অইয়েদে?” (সোনা, কোন জায়গায় জখম হয়েছে?)
হাসিম জখমী পা দেখায়। বুড়ী সযত্নে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেয়। বড়ো বড়ো নিশ্বাস ছাড়ে। এ নিশ্বাসের ভেতর থেকে অনেক অগ্নিগিরির লাভা নিঃসরিত হয় নীরবে। নাতি দাদী দু’জনের কেউ কথা বলে না। দু’জনেই বেদনার নীরব স্রোতে অবগাহন করে। একজনের মুখে অন্যজন সান্তনার ভাষা খুঁজছে। বুড়ী হাসিমের বুকে মুখে কাঁধে সারা শরীরে হাত বুলোয়। বাম চোখে ছানি পড়েছে, ভালো দেখতে পায় না। তবু দৃষ্টির সবটুকু ধার উপুর করে হাসিমের মুখে কি দেখতে চায়। হরিমোহনের মুখের আদল?
আঁচলের গিঁঠটা খুলে গুণে গুণে দশটা রুপোর টাকা, দশখানা পাঁজরের মতো সন্তর্পনে হাসিমের হাতে তুলে দিলো। চেরাগ বাতির আলোকে টাকার বুকের মহারাণীর ছবিটা জ্বলে উঠলো চিক চিক করে। একদৃষ্টিতে হাতের টাকাগুলোর দিকে চেয়ে হাসিমের দু’চোখের কোণে দু’ফোঁটা অশ্রু নির্গত হলো। শিশু যেমন একমুঠো জোছনা চেপে ধরে হাসিমও তেমনি টাকাগুলোকে চেপে ধরলো। এ টাকাতে কিসের স্পর্শ যেন এখনো লেগে আছে।
“নাতি, এহন যাই। অধর ঘরত গেলে গোলমাল লাগাইব।” (নাতি, এখন যাই। ঘরে গেলে আবার অধর একটা গোলমাল বাধিয়ে বসবে।)।
বাকী কথা শেষ না করে বুড়ী উঠে দাঁড়ায়। সুফিয়া হাতে লাঠিটা তুলে দিয়ে কিছু দূর এগিয়ে দিয়ে আসে। খুবই সন্তর্পণে লাঠি ঠক ঠক করে পথ চলে। কেউ যদি দেখে ফেলে? আঁধারের ভেতর নদীর মতো শুশ্রূষার জল, পিপাসার বারি হয়ে আসে বুড়ী আঁধারেই চলে যায়। দিনের আলোতে দেখা নেই। অন্তরেও আঁধার নদী আছে। তারই স্রোতে ভেসে আসে সমাজের অনুশাসন ডিঙিয়ে রাতের বেলা নাতিকে দেখার জন্যে। হৃদয়ের এ লাবণ্যরেখার নদী কোনোদিন কি দিনের আলোর মুখ দেখবে? বুড়ী মনে মনে সে কথাই ভাবে।
৩. সওদা করার জন্যে বাজারে
হাসিম সেদিন কিছু সওদা করার জন্যে বাজারে গিয়েছিলো। কবরস্থানের পাশ দিয়ে দুপুরবেলা ঘরে ফিরছিলো। পাকা ঘাটলার কাছে কাজী বাড়ীর গোলাম কাঁদেরের সঙ্গে দেখা। বহু কালের ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটলায় বসে কা’কে সশব্দে গাল দিচ্ছিলো কাজী গোলাম কাদের। গাল দেয়ার সময় গোলাম কাঁদেরের মুখের ভাব পরিবর্তিত হয়। ঘাড়ের ঝুলে পড়া রগের মধ্যে দুটো রগের রং লাল হয়ে যায়। কবুতরের ভাঙা বাসার মতো ভগ্ন শরীরের আবেষ্টনী ছিন্ন করে বৈদ্যুতিক তারের মতো উত্তপ্ত হৃদপিণ্ডটা বেরিয়ে আসতে চায় বুঝি! শ্বেত-শুভ্র বুকের ধার অবধি লুটিয়ে পড়া দাড়ি তরঙ্গায়িত হয়ে কেঁপে ওঠে। চোখের ঘোলাটে দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক একটা জ্বালা ফুটে বেরোয়।
হাসিমকে দেখতে পেয়ে গাল দেয়া বন্ধ করে গোলাম কাদের। এক কানে দড়ি দিয়ে আটকানো চশমার কাঁচ মুছে হাসিমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ
“হেইভা কন?” (ওটা কে?)।
“আঁই দাদা।” (আমি দাদা।) হাসিম বাজারের ঠোঙ্গাটা বাম থেকে ডান হাত বদল করতে করতে উত্তর দিলো।
“।কানে ন হুনি, বড় গরি ক।” (কানে শুনতে পাইনে, বড় করে বলো।)
“আঁই দাদা।” ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটলার কাছটিতে কাজী গোলাম কাঁদেরের দৃষ্টির তলায় গিয়ে জবাব দেয়।
অবশেষে চিনতে পারায় খুশি হয় বুড়ো। দাঁতহীন মাড়ি দেখিয়ে হাসতে চেষ্টা করে। বিবর্ণ গামছাটা দিয়ে পাশের জায়গাটিতে দুর্বল অশক্ত হাতে কটা বাড়ি দিয়ে বললোঃ
“অ হাসিম মিয়া, বয়।” (ও, হাসিম মিয়া, বসো।)
বাড়িতে হাসিমের অনেক কাজ। তবু বুড়ো কাজী গোলাম কাঁদেরের অনুরোধ ফেলতে পারে না। কাজী বাড়ির গোলাম কাঁদেরের সঙ্গে হাসিমের কোথায় একটা অস্পষ্ট মিল আছে। খুবই অস্পষ্ট, শাদা চোখে ধরা পড়ে না। হাসিমকে বসিয়ে বুড়ো আবার গালাগাল দিতে থাকে।
“হারামজাদা, বেল্লিক বাঁদরের বাইচ্চা, লাথি মারি মাথার ছড় উলডায়া ফেলাইয়াম। বাদীর বাইচ্চা কন ঝাড়ত কন বাঘ আছে কইত না পারে।” (হারামজাদা, বেল্লিক বাঁদরের বাচ্চা, লাথি দিয়া মাথার ছড় উলটে ফেলবো। বাদীর বাচ্চা জানে না কোন জঙ্গলে কোন বাঘ থাকে।)
হাসিমের অসোয়াস্তি লাগে। মাথার ওপরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ তদুপরি বুড়ো গালাগালি করার সময় তিনশ বছর আগের ইউসুফ কাজীর রক্ত শিরায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাইশ গ্রামের জায়গীরদারী স্বভাব মাথা চাড়া দেয়। অথচ লোকটা অসহায় চরম অসহায়। এ অসহায়তাতে আঘাত লাগলেই বুড়ো আভিজাত্যের পুরোনো গর্তের মধ্যে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। হাসিম জানে, ওটা গোলাম কাদের বুড়োর স্বভাব। তবু তার বুকের ভেতর ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা দেয়। শরীরের রক্ত চিনচিন করে। তাকে লক্ষ করেই যেনো বুড়ো কথাগুলো বলছে।