বড়ো বিবির দয়ার শরীর রাজী হয়েছিলো। কিন্তু শুনতে পেলো মাতব্বর। গরু ঠেঙ্গানো লাঠিটা দিয়ে নিজের ছোট বৌ এবং দু’ছেলের বউয়ের সামনে বড়ো বিবিকে ঠেঙ্গিয়ে দিলো।
“মউগের ঝি, এই ভাবে আঁর গিরোস্থি ধ্বংস গরিবি, দরেয়াত ডোবাবি। (মাগের ঝি, তুই আমার গৃহস্থী ধ্বংস করবি, সমুদ্রে ডুবাবি) মাতব্বরের মুখ দিয়ে আরো নানা রকম অশ্লীল কথা বেরিয়ে আসে।
সুফিয়া তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসে। তাকে দেখে মাতব্বরের মুখে গালাগালির খৈ ফোটে।
“এই বান্যিয়ার পুতের বউ, আর তোরে ঘরের কাছে পিছে দেহিলে ঝুঁড়া কাডি লইয়ম।” (এই বেনের বউ, আবার তোকে ঘরের কাছে দেখলে খোঁপা কেটে নেবো৷)
ওদের অসম্ভব কিছু নেই। খোঁপাটিতে হাত দিয়ে অন্ধকারের ভেতর পা চালায়। বুকটা ভয়ে চিব ঢিব করে। পুকুর পাড় ছাড়িয়ে মাতব্বরের গরুর গোয়ালের কাছে এসে হাঁপায়। অন্ধকারের ভেতর একজনকে দেখে চমকে উঠে। মাতব্বরের ছোটো ছেলে লড়াই দেয়ার ষাঁড়টাকে বিল থেকে কলাই চুরি করে এনে ধুনে ধুনে খেতে দিচ্ছে। সুফিয়াকে দেখতে পেয়ে সে ফিসফিসিরে ডাকে। এমনি ডাক তাকে তার বাপ মাতব্বরও ডেকেছে অনেকদিন।
“খোদার কহর পড়ক তোর উয়র।” (খোদার অভিশাপ পড়ুক তোর উপর।) চীকার করে বলে।
গর্ভের ভারে হাঁটতে পারে না সুফিয়া। কিছু দূর দৌড়ে ফুঁপিয়ে উঠে। ছেলেটা চীকার করে গালাগাল করে। হঠাৎ অন্ধকারে কোত্থেকে মাতব্বরের আবির্ভাব হলো। উচ্চঃস্বরে বললোঃ
“মউগের ঝিয়ের ঠ্যাং ভাঙ্গি দে রইস্যা। মউগের ঝি চোর।” (মাগের ঝিয়ের ঠ্যাঙ ভেঙ্গে দে রসিদ। মাগের ঝি চোর।)
.
কোনো রকমে সুফিয়া দু বন্য জন্তুর আওতার বাইরে চলে আসে। তার পরনের শাড়ি খুলে গিয়েছে। খুলে যাওয়া শাড়িটা পড়বার জন্যে কাজী রহমতের কবরের কাছে একবার দাঁড়ায়। কাপড় পড়তে ভুলে যায়। স্ফীত উদরের সঙ্গে কাপড়টা চেপে ধরে কাজী রহমতের কবরে তিনটি লাথি মেরে শোধ নিলো নীরবে। শব্দ করে বললোঃ
“আল্লা, জালেমের উয়র তোর গজব পড়ক। জালেমের বংশ নির্বংশ অউক।” (আল্লা, অত্যাচারীর উপর তোমার অভিশাপ পড়ক।)।
হরিমোহন মুসলমান হয়েছিলো। গোকুল পপাদ্দারের সোনায় ভর্তি লোহার আলমারীর ডালা তার জন্যে চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। গোকুল ছেলেকে ক্ষমা করেনি। ক্ষমা করতে পারেনি। এ অপমান হজম করে বেশি দিন বাঁচে নি। রয়ে গেলো গোকুলের বিধবা স্ত্রী, সম্পর্কে হাসিমের দাদী। পদে পদে মেনে চলে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। কিন্তু এক জায়গায় বুড়ি দুর্বল, বড় অসহায়। তার কনিষ্ঠ সন্তান। হরিমোহন। আঁতের মধ্যে দশমাস দশদিন ছিলো। সে ছেলে বড় হলো, তারপর মুসলমান হয়ে গেলো। এ জন্য স্বামী তাকেও ক্ষমা করে নি। পেটে ধরেছিলো বলে যেন সমস্ত দোষ তারই। কাজী বাড়ির বাদীকে বিয়ে করলো, মারা গেলো। হায় রে সমাজ! হায় রে ধর্ম! মৃত সন্তানের মুখ বুড়ী দেখতে পারেনি। হিন্দু হোক, মুসলমান হোক তারই সন্তান, তারই গর্ভস্থ ভ্রুণ হতে জন্ম, হরিমোহনকে কি ভুলতে পেরেছে? আরো তিন ছেলে এবং এক গণ্ডা নাতি কি হরিমোহনের স্থান পূরণ করতে পেরেছে?
হাসিমের অসুখ-বিসুখ হলে বুড়ী দেখতে আসে। আসে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে– যাতে কেউ দেখতে না পায়। হোক না নিজের আঁত পচা ছেলের ছেলে। তবু তো মুসলমান; বিধর্মী। কিন্তু হাসিমের বিপদে আপদে থুখুরী মনখানা আনচান আঁকুপাঁকু করে কেন? কেন করে? স্বামীর গচ্ছিত মরণের সম্বল থেকে রূপোর টাকা দিয়ে যায় দু’চারটা করে। ছেলেরা নাতিরা প্রচণ্ডভাবে শাসিয়েছে। শ্মশানে বয়ে নেবে না বলে ভয় দেখিয়েছে। মরলে গোর দেবে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছে। বুড়ী ভয় পায়, শিউরে ওঠে। যদি তাকে শ্মশানে বয়ে নিয়ে না যায়, যদি তাকে কবর দেয়া হয় মুসলমানের মতো? তা হলে? তা হলে? অস্ফুটে উচ্চারণ করে।
“আঁরে ক্ষেমা গইয্য তেত্রিশ কোটি দেওতা। আঁর মনেত মায়া ছাড়া আর কিছু নাই।” (আমাকে ক্ষমা করো তেত্রিশ কোটি দেবতা। আমার মনে মায়া ছাড়া কিছু নেই।) তেত্রিশ কোটি দেবতার উদ্দেশ্যে হাত ঠেকিয়ে সভক্তি প্রণাম করে।
হাসিমের কথা চিন্তা না করার জন্যে সচেতন মনে বারবার সংকল্প করেছে। হাসিম তার কে? তার যে একটি ছেলে ছিলো, তার নাম হরিমোহন সে কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু, যুক্তি মানে না হৃদয়। রক্ত ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
হাসিমের পায়ে জখমের সংবাদ শোনা অবধি বুড়ীর মনটা বার বার কোণাকোণি হয়ে যাচ্ছে। কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না। মনের কষ্টিপাথরে বিজলী রেখার মতো মুসলমান নাতির জন্যে বেদনা জ্বলে ওঠে। কতো গভীর সে বেদনা। রাতে ঘুমোতে পারে না। পথে বেরোতে পারে না। একে তো বিষ্টি, তদুপরি পথঘাট পিছল।
বিষ্টি বন্ধ হবার পরের দিনই সের দুই চালের একটা পুঁটুলি বেঁধে, স্বামীর দেওয়া সঞ্চয় থেকে ক’টি রূপোর টাকা থান কাপড়ের আঁচলে নিয়ে পথে নামলো। সন্ধ্যার অন্ধকারে লাঠি ঠক ঠক করে যখন হাসিমের ঘরের কুয়োটির সামনে এলো, দেখতে পেলো শাদা কাপড় পরা কে একজন এদিকে আসছে। তাড়াতাড়ি বুড়ী চালের পুঁটুলিটা পরনের থান কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে কেয়া ঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কাঁটার আঘাত সমস্ত শরীরকে জর্জরিত করে। একটি নিশ্বাসও না ফেলে চুপ করে রইলো। আঁধর হাঁ, অধরই তো চলে গেলো। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। দেবতাকে ধন্যবাদ দেয়। অধর নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলে বুড়ী অনুচ্চকণ্ঠে হাসিমকে ডাকাডাকি করে। চড়াতে পারে না গলার স্বর। এ পাড়ার কেউ শুনলে আরো এক অনর্থ বাধবে। দাঁতহীন মুখ দিয়ে ঠিক মতো স্বর বেরোয় না। অনেক ডাকাডাকির পর সুফিয়া একখানা বাতি নিয়ে কুয়োর পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করেঃ