কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে আসছে জোহরা। তার সুগৌর ফর্সা মুখমন্ডলে শেষ বিকেলের ছটা লেগে অপরূপ দেখাচ্ছে। চুল বাঁধেনি। রুক্ষুচুলে এলোলামেলো জোহরার চেহারার মধ্যে বিষণ্ণ সৌন্দর্যের আমেজ। চোখ দুটো টলো টলো। মুখের ওপর থমকে আছে একটা কান্নার আবেগ। হাসিম ডাকে।
“আয় বইন, আয় বয়।” (এসো বোন, এসো, বসো।)
একখানা সিঁড়ি টেনে নিয়ে বসলো জোহরা। তার মুখে কোনো কথা নেই। রোগক্লিষ্ট যন্ত্রণাকাতর হাসিমও অনুভব করে জোহরা বড় দুঃখী। তার জোয়ান খসমটা মারা গেছে বিশ দিন আগে। চা বাগানে সাবের মতো অমন সুন্দর মানুষটা মাত্র এক সপ্তাহের জ্বরে মারা গেলো। মরার সময় নাকি জোহরাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলো। খলু মাতুব্বর ভাতিঝিকে যেতে দেয় নি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাসিম জোহরার কথা শুনছে। পাড়া-পড়শী তার শয্যার পাশে টুকরো টুকরো আলাপ করছে এ বিষয়ে। স্মরণে জেগে আছে সে সব। রাশি রাশি শারীরিক মানসিক যন্ত্রণার তাপে চাপে হারিয়ে যায় নি। খলু মাতব্বর বলেছে, আইন মতে জোহরা কবীরকে কাজীর অফিসে গিয়ে তালাক দিয়েছে। সুতরং কবীর এখন বেগানা পুরুষ। শরীয়ত মতে বেগানা পুরুষের মরা মুখ দেখাও হারাম। হারামের জন্য জোহরা খসমকে দেখতে যেতে পারে নি।
আগে আরো দু’দুবার বিয়ে হয়েছে জোহরার। মাতব্বর মামলাবাজ, দাঙ্গাবাজ মানুষ। আগের দুখসমের মধ্যে একজনের জমি মামলা করে নিজের চাষে নিয়ে এসেছে এবং অন্য জনের নামে অলংকার ও খোর পোষের নালিশ করে সব কিছু আত্নসাৎ করেছে। তৃতীয়বার সাতবাড়িয়ার কবীরের সংগে জোহরার বিয়ে হয়েছিলো, গেলো ফাল্গুনের আগের ফাল্গুনে। জোহরার শ্বশুরের জমি নিয়ে মামলা মকদ্দমা চলছিলো। জোহরা অশান্তিতে আছে এ অজুহাতে নাইয়র এনে আর শ্বশুরবাড়ীতে যেতে দেয়নি। কাজীর অফিসে গিয়ে জোহরাকে দিয়ে কবীরকে তালাক দিতে বাধ্য করে তিন কানি জমি দখলের ফন্দি করেছে। তালাক দেওয়ার পরেও কবীরের প্রতি জোহরার টানের কথা মাতব্বর বিলক্ষণ জানতো। জমি জোহরার নামে। মেয়েমানুষের গতি কি বোঝা যায়! কথায় বলে বারো হাত কাপড় পরেও ন্যাংটা থাকে। এখন কবির মরেছে। আপদ বিপদ চুকে বুকে গেছে। জমি নিজের চাষে নিয়ে আসার পথ নিষ্কটক। সে আনন্দে খলু মাতব্বর বগল বাজাচ্ছে।
“সুফিয়া বু কড়ে গেইয়েদে?” (সুফিয়া বুবু কেথায় গিয়েছে?) জিজ্ঞেস করে জোহরা।
“কডে জানি গেউয়ে বইন। কড়ে আর যাইব, সের আধসের চইল উধার চাইবার লায় গেইয়েদে আর কি। আঁরে ত আল্লায় নেয়মত দিয়ে” (কোথায় জানি গিয়েছে বোন। সের আধসের চাল ধারটার চাইতে গেছে। আল্লা তো আমাকে অমৃত দিয়েছে।)
জোহরা কথা কয় না। চুপ করে থাকে। চোখের দুটো টলোটলো মণিতে উদগত অশ্রু। হাসিম এলোমেলো বিস্রস্ত সৌন্দর্যের পানে চেয়ে থাকে। লজ্জা পায়। নড়ে বসতে চেষ্টা করে। পা-টা ব্যাথা জানায়।
“আঁরে এক দলা বিষ দিবানি হাসিম বাই?” (আমাকে এক দলা বিষ যোগাড় করে দেবে হাসিম ভাই?)
“বিষ কিয়ার লাই বইন?” (বিষ কিসের জন্য বোন?)।
“হেই কথা বুঝাইতে পাইরতাম নয়, আল্লায় আঁরে হেই মুখ ন দে।” (সে কথা বুঝিয়ে বলতে পারবো না, আল্লায় আমাকে সে মুখ দেয় নি।)।
“বইন, জগত সংসারে হক্কল জিনিস বিষ। হক্কল কিছু সহ্য গরন পড়িব। উতলা অইলে ত চইলতো নয়।” (বোন, জগৎ সংসারে সক্কল জিনিস বিষ। সব কিছু সহ্য করতে হবে। উতলা হলে চলবে না।)
কথাগুলো বলে বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করে হাসিম।
জোহরার অন্তরের বেদনার ঝড় হাসিমের সহানুভূতির ছোঁয়ায় ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু হয়ে গণ্ডদেশে গড়িয়ে পড়ে। আস্তে আঁচলে মুখ মুছে ফেললো। তার চোখে পানির দীর্ঘায়ত ফোঁটাগুলো বড়ো দুঃখের। হাসিমের চোখে বড় সুন্দর লাগে।
“জোহরা বু আইজো ন আইল” (জোহরা বুবু আজো এলো না।) বলে ধীরে ধীরে পা ফেলে সচল বিষণ্ণ সৌন্দর্যের মূর্তির মতো কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে ঘনায়মান সন্ধার অন্ধকারের দিকে হারিয়ে গেলো।
সুফিয়া গিয়েছিলো খলু মাতব্বরের বাড়িতে আধসের চাল ধার চাইতে। পড়শীদের কারো চাল নেই। এতোদিন পর হাসিম বিছানা থেকে উঠে বসেছে। সেজন্য আল্লাহর কাছে হাজার শোকর। অসুস্থ, অভুক্ত স্বামী যদি কিছু খেতে চায় তা হলে সামনে কি বেড়ে দেবে? আট দিন একলাগা বৃষ্টির পরে পড়শীদের কারও ঘরে চাল থাকার কথা নয়। দু’এক জনের কাছে চাইবার পরে তার অনুমানের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে। সকলে জোহরাদের মতো আঁচলে করে এনে পাতিলে ঢেলে রান্না করে জীবন চালায়।
উপায়ান্তর না দেখে খলু মাতব্বরের বাড়িতে গেলো। মাতব্বর চালাক মানুষ। বিষ্টির পর চালের দাম চড়বে জানে। সে জন্য ধানের কল থেকে চাল ছাঁটিয়ে এনেছে। চার পাঁচ ভার হবে। মাতব্বরের বড় বৌ, ছোট বৌ, দু’ছেলের বৌ সকলে পাটি বিছিয়ে চাল ঝাড়ছে, চালছে।
সুফিয়া বড় বিবির কাছে অত্যন্ত মিনতি করে বললো, “খালা, তোঁয়ারার জামাই ভাত খাইবার লায় সের আধাসের চইল উধারের লায় আস্যিদে। নদিনের পরে আজিয়া মোড়ে উঠি বস্যে, খালা আঁরে এক সের চইল দেও… আঁই ঝাড়ি চালি দিয়ম।” (খালা, তোমাদের জামাইয়ের ভাত খাওয়ার জন্য সের আধসের চাল ধার চাইবার জন্য এসেছি। ন’দিনের পরে আজ মোটে উঠে বসেছে। খালা, আমাকে সের আধসের চাল ধার দাও–আমি ঝেড়ে চেলে দেবো।)