১. বৈশাখের শেষ
সূর্য তুমি সাথী – উপন্যাস – আহমদ ছফা
উৎসর্গ
ড: মফিজুদ্দীন আলী মুহাম্মদ চৌধুরী
শ্ৰদ্ধাস্পদেষু
বৈশাখের শেষ। আধা বছর জুড়ে বিশাল নীলাকাশে সূর্যের রূপোলী আক্রোশ সহস্র শিখায় শ্যামল পৃথিবীতে আগুন ঢেলেছে। অগ্রহায়ণের শেষাশেষি একদিন আসমানের চার কোণে জমাট বাঁধা কালো মেঘ কালো গাইয়ের ওলানের বরণ ধরেছিলো। বজ্রেরা চীৎকার করে ফেটে পড়েছিলো। মেঘের বুক চিরে চিরে বিজুলীর শাণিত ছুরি ঝিকঝিকিয়ে জেগেছিলো। লোকজন আতঙ্কে ফরিয়াদ করেছিলো অগ্রহায়ণ মাস পাকা সোনারঙ ধান ঘরে আসার মৌসুম। এমনি সময়ে যদি বৃষ্টি নামে। কথায় বলেঃ
‘যদি বিষ্টি আগনত
মানুষ যায় মাগনত’
(অগ্রহায়ণে যদি বৃষ্টি হয় মানুষ ভিক্ষে করতে বেরোয়।)
লোকজনের ভাগ্য ভালো। আসমানের আল্লাহর উদ্দেশে শোকর গুজার করেছিলো। অগ্রহায়ণে বিষ্টি হয় নি। পৌষে না। মাঘে না। ফাঙ্গুন-চৈত্র গেলো। বৈশাখও যাই যাই; আর কয়দিনই বা বাকী। এরি মধ্যে আকাশ একবারও করুণায় সজল হয়ে ওঠেনি। গনগনে সুর্যের হতাশনে রবিশস্যের ক্ষেত জ্বলে গেলো। ঢোড়া সাপের মতো তরমুজ লতার লক্লকে প্রসারিত ডগা মিইয়ে এলো। খরায় গাছের পাতারা তামাটে রঙ ধারণ করলো। আসমানের বিশাল ভয়ঙ্কর শুভ্র শিখার কুণ্ড লক্ষ লক্ষ আগুনে রসনার তাপে পলকে পলকে ধরিত্রীর রূপরস শুষে নিচ্ছে; গোলাকার প্রসারিত খোলের তলায় গলানো রূপোর মতো শিখারা ঝিলিমিলি খেলা করে। ডাইনে-বাঁয়ে-সামনে-পিছে যতদূর যায় চোখ–আগুন, আগুনের হলুদ শিখা। মাঠে আগুন, গাছে আগুন ফসলে আগুন, প্রকৃতির শিখাহীন নীরব প্রদাহের মতো মানুষের অন্তরে উদরেও আগুন, আগুনের কণা। সহস্র শ্রাবণের অক্লান্ত বর্ষণের ঝিকিমিকি বহ্নিমান, অনিভন্ত।
আগুনের জোয়ার ফোলা সাগর সাঁতরে যেনো এলো হাসিম। তার বুকে-পেটে, চোখে-মুখে আগুন। ধুকে ধুকে বন্যা পুকুরের বটতলায় এসে কাঁধের লাকড়ির ভারখানা নামালো। বটগাছ যেখানে শীতল ছায়া মেলে দিয়েছে, সেখানেই ছায়ার কোলে আধা সেদ্ধ শরীরখানা এলিয়ে দিলো। মাটির ভাপে শুকিয়ে যাওয়া ঘাসের ওপর বাদবাকী শরীরখানা রেখে চোখ বুজে রইলো। কিছু ভাবতে পারে না হাসিম। ভাবনার সূত্র জ্বলে গেছে। বন পেরিয়ে বিলে নামার পর থেকে এ বটগাছ স্নেহময়ী জননীর মতো ছায়াভরা হাতছানি ডেকে ডেকে পাক্কা চার মাইল পথ গরম তাজা বালুর ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে তাকে। চোখ বুজে থাকতে পারে না। আগুনে পোড়া অর্ধগ্ধ শরীরের চেতনায় কি এক অনুভূতি জেগে উঠতে চায়। সূর্যের ধারালো নখর বুকের ভেতর যেখানে কজে, সেখানে তপ্ত গরম ছ্যাকা দিয়েছে।
লুঙ্গিটা বদলে গামছাখানা কোমরের গিঠ খুলে পরে নিলো। তারপর তালগাছের পিছল ঘাটের ওপর বসে দু’হাত পানিতে ডুবিয়ে আঁজলা ভরে এক আঁজলা পানি তুলে নিলো। ফেলে দিলো। পুকুরের পানিতেও আগুন। এক পা, দুপা করে ধীরে ধীরে গলা পানিতে নেমে এলো। ঝুপ করে একটা ডুব দিলো, আরেকটা ডুব দিলো। ধুলোয় ধুসরিত গা ডলতে ডলতে অনেকগুলো ডুব দিলো। পানির ওপরে কালো মাথা জাগিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। হাসিমের দেহের উত্তাপ শীতল পানি শুষে নিচ্ছে। লোমকূপের গোড়ায় কাঁপছে স্নিগ্ধ শীতল অনুভূতি। তার প্রাণ, অনুভূতি ফিরে এলো দেহে। কেমন শান্ত, নিবিড়, মেহঘন ছোঁয়া।
একটা কক্সবাজারের বাস হর্ণ বাজিয়ে দক্ষিণে ছুট দিলো। দু’টো রিক্সা আঁকাবাঁকা রোডের ওপর ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে। ধীর মন্থর গতি। টুং টাং ঘন্টাধ্বনি বাতাসে ভেসে চলে যায় অনেক দূর। আকাশের বুকে তীক্ষ্ণ তেরছা একটা রেখা টেনে একটা পাখি উড়াল দিলো। সূর্যের আলো বাদামী রঙের পাখনায় চিকচিক করে ঝলসে ওঠে। একটা চিল দিকচক্ৰবালে চক্রাকারে ক্কর খেলছে। পানির সমতলে পড়ছে ছায়া। রোদজ্বালা দুপুরের তপ্ত নির্জনতাকে ফালি ফালি করে কেটে চিহি স্বর বেজে উঠছে। চোখ-জ্বলা রোদে চিলের মর্মন্তুদ চিহি ডাক বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়… আলোড়নের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
গা ধোয়া সেরে পুকুর থেকে উঠে আসে। গামছা বদলে আবার লুঙ্গি পরে নিলো। চিপে চিপে ঝেড়ে ফেললো সমস্ত পানি। তারপর গামছাখানা মাথায় মেলে গিয়ে বসে বটগাছতলায়। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। বাতাসের তোড়ে ছোটো ছোটো প্রশাখাগুলো দুলে উঠে। নির্জনতার ভেতর থেকে শরশর শব্দ আসে। বটগাছ যুগ যুগান্তরের উত্থান-পতনের সাক্ষী। হাতির গুঁড়ের মতো বিরাট বিরাট ঝুড়িগুলো তৃষ্ণার টানে মাটিতে নেমে এসেছে। ডালপালা পত্র-পল্লবে আকাশখানা কিছুদূর অদৃশ্য করে ফেলেছে। মৃত্তিকার অন্তরের সংগোপন রসে পাতাগুলো সবুজ, সরস। হাওয়ার ঘায়ে কেঁপে কেঁপে ওঠা প্রাণময় প্রসারিত ছায়ার মধ্যে মৃত্তিকার সংগোপন মমতাকেই মেলে ধরেছে।
একটু ভালো লাগছে হাসিমের। সারা শরীরে টলছে ঘুম ঘুম ঝিমানি। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘোরাফেরা করে চোখ। ওই হোথা মগডালে বাসা বেঁধেছে দুটো কাক। কোকিল একটা ডাকছে কু…কু। পাতার ফাঁকে অস্বাভাবিক জ্যোতির্ময় কালো দু’চোখ দেখা যায়। কতো কালো আর কণ্ঠস্বর কি মধুর! অন্তরের ভেতরটা পর্যন্ত ঠান্ডা করে দেয়। সবচে’ নীচের ডালটার দিকে চোখ পড়তে চমকে ওঠে।