আলি কেনান তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি দিয়ে অনুভব করতে পারে, নিয়মিত খেতে না পেরে তার চেহারা এমন শুঁটকি হয়ে আছে। মাস কাবারি টাকা দিলে আরবীতে তাবিজ-কবজ লিখে দেরে এটা সে ধারণাই করে নিয়েছিলো। তবু মনে একটা খটকা ছিলো। এই জাতের মানুষ মিনমিনে হলেও অহংকারী হয়। তাই প্রস্তাবটা সরাসরি পাঠায়নি। তার বদলে এক সন্ধ্যেয় মিলাদ পড়ার দাওয়াত করলো।
ইমাম সাহেব প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন, কিনা মনে মনে দোটানায় ছিলেন। তিনি লোকমুখে শুনেছেন আলি কেনান অনেক শরিয়ত বিরোধী কাজ কারবার করে। নিজের চোখেও দেখেছেন। ইমাম সাহেব নিজে ওহাবী তরিকার মানুষ। কবর নিয়ে হৈ চৈ এসব মোটেও পছন্দ করেন না। তার যদি ক্ষমতা থাকতো এবং মহল্লার মানুষের সমর্থন পাওয়া যেতো, তাহলে কবে আলি কেনানকে ফুলতলি ছাড়া করতেন। পাঁচ মাস কাজ করে এক মাসের মাইনে পাননা যেখানে-সেখানে ধর্ম কাজ করার উৎসাহ আপনা থেকেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তাই প্রতি শুক্রবার আলি কেনানের শরা, শরিয়ত বিরোধী কাজ কারবারের কথা তুলবেন, তুলবেন মনে করেও তুলতে পারেননি। তার মনেও একটা শংকা ছিলো। আলি কেনান অল্প দিনের মধ্যে ফুলতলি এলাকার সামাজিক শক্তি হয়ে উঠেছে। তার ওখানে প্রতি বৃহস্পতিবার গান বাজনা হয়। ওতে মহল্লার অনেক তরুণ যোগ দিতে আরম্ভ কওেছে। সর্দার সাহেবের বড়ো ছেলে এসব ব্যাপারে আলি কেনানের ডানহাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইমাম সাহেব লোকমুখে শুনেছেন স্বয়ং সর্দার সাহেব নাকি একবার গোটা রাত ওখানে গান বাজনা শুনেছেন। আলি কেনান মানুষটাকে ইমাম সাহেব মনে মনে ঘৃণা এবং ঈর্ষা করেন। ঘৃণা করেন এ কারণে যে তার মধ্যে একটা শয়তানি শক্তি আছে। এরই মধ্যে ফুলতলির অনেক তরুণ তার খপ্পরে পড়তে আরম্ভ করেছে। আলি কেনান তাদের শরিয়ত বিরোধী কাজে উৎসাহ যোগায়। ইমাম সাহেব দশ বছর ধরে এই মহল্লায় বসবাস করছেন। নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হলে তিনি আজান দেন। মৃত্যু হলে জানাজা পড়ান। এমনকি মৃত্যুর পূর্বে তিনি ফুলতলির নরনারীদের জীবনের শেষ তওবাও পাঠ করান। ভাগ্যের কি পরিহাস ইমাম সাহেবকে কেউ গেরাহ্যের মধ্যে আনে না। ছোটো বাচ্চারাও তাকে নিয়ে নানা তামাশা করে। অথচ এই আলি কেনান কদিন হলো এসেছে, বড়ো জোর ছ মাস । মহল্লার মানুষদের নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই ইমাম সাহেব আলি কেনানকে ঈর্ষা না করে পারেন না।
ইমাম সাহেব জ্ঞানতঃ ঈর্ষা করতে চান না। কিন্তু আল্লাহ তো তাকে মার্টির মানুষ করে পয়দা করেছেন। তবু ইমাম সাহেবের কোনো আফসোস নেই। খোদ রসুল করিমই তো বলে গিয়েছেন, আখেরি জামানায় ফেতনা এবং গোমরাহির শক্তি সতুর গুণ বেড়ে যাবে। এসবই ছিলো আলি কেনানের মিলাদের দাওয়াত গ্রহণ করবার দ্বিধা দ্বন্দ্বের আসল কারণ। সরাসরি দাওয়াত কবুল না করতেও তার মন চাইছিলো না। আলি কেনান দাওয়াতের সঙ্গে নগদ পঞ্চাশটি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। তখন পঞ্চাশ টাকা দিয়ে আস্ত একটি গরু পাওয়া যেতো। ঐ তুচ্ছ টাকাকটিই গোল বাধালো । ইমাম সাহেব গোটা মাসে আজান দিয়ে এবং শুক্রবারে ইমামতি করে মাত্র পঁয়ত্রিশ টাকা পান। কোনো কোনো সময় পঁয়ত্রিশ মাস অপেক্ষা করেও টাকাটা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। ইমাম সাহেব চিন্তা করলেন,
আমি এই পঞ্চাশটি টাকা ছাড়ি কেনো? যদি ছেড়েও দেই তা হলো আমার কি লাভ? এখন লোকে পাঁচ সাত টাকা পেলে মিলাদ পড়ে। হাতে হাতে পঞ্চাশ টাকা পাওয়া গেলে বায়তুল মোকাররমের ইমাম সাহেবও চলে আসতে পারেন। তিনি আরো ভাবলেন, আমি তো আল্লাহর নামে হেদায়েত করবো। ওতে তো দোষের কিছু নেই। গোমরাহির পথে কেউ গেলে তাকে তো আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনাও নায়েবে রসুলদের একটা দায়িত্ব। অতএব ইমাম সাহেব দাওয়াত কবুল করলেন। ইমাম সাহেব মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন, তিনি শরিয়ত বিরোধী কাজ কর্মের কঠোর নিন্দা করবেন। আলি কেনানের নাম নেবেন না। তবু আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে ছাড়বেন না, আলি কেনানই এলাকায় যুবকদের কুপথে যাওয়ার ইন্ধন জোগাচ্ছে। কিন্তু সেদিন এশার নামাজের পর মিলাদ পড়তে এসে কোনো কথাই তিনি মুখ থেকে বের করলেন না। আলি কেনানের প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে একটা চড়ই পাখি বলে মনে হতে লাগলো। তাই তিনি শরিয়ত খেলাপ, কবর আজাব ওসবের ধার দিয়েও গেলেন না। কেবল কোরান তেলাওয়াত করলেন এবং দরুদ শরীফ পড়লেন। তারপর মোনাজাত করে ফেললেন।
নামাজ শেষ হয়ে গেলে আলি কেনান স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ফুলতলির সমবেত মানুষদের কাছে জানতে চাইলো,
এ্যাই তরা ইমাম সাবরে চিনোস।
অনেকে মাথা ঝুলিয়ে বললো,
হ্যাঁ তারা ইমাম সাহেবকে চিনে বটে। তিনি মসজিদে পচবেলা আজান দেন, শুক্রবার ইমামতি করেন এবং কেউ কখনো মারা গেলে জানাজার নামাজ পড়ান। এবার আলি কেনান ভীষণ রেগে গেলো।
শালা তরা বলদ ছিলি আর সারা জীবন বলদই থাকবি। খাঁটি মানুষ চেনার তাকতনি আল্লাহ তগো দিছে। বাবাজান বু আলি কলন্দর আমারে খোয়াবে দ্যাহা দিয়া কইছেন,
তুই ইমাম সাবরে ডাইক্যা মিলাদ পড়া। হের লাইগ্যা মিলাদ পড়াইলাম। আমার কারবার দেল কোরান লইয়া। পাতা কোরান ভাইজ্যা যারা খায়, হেগোরে আমি ধর্মের দারোগা-পুলিশ মনে করি। কিন্তু বাবাজান বু আলি কলন্দর আমারে কইছেন,