আলি কেনান সকলের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। কিন্তু তারপর তার মুখ দিয়ে অশ্লীল অশ্রাব্য গালাগালির তুবড়ি ছুটতে থাকে :
‘খানকি মাগি, শাউরের পো’ এই সব মধুর শব্দ তার মুখ দিয়ে অবলীলায় বেরিয়ে আসতে থাকে। একেক সময়ে তার বাহ্য জ্ঞান লোপ পাবার দশা হয়। তখন কারো পাছায় লাথি মারে। কাউকে চুল ধরে ওঠ বোস করায়। কোনো মহিলাকে একটা পাউরুটির টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
নে মাগি এইড্যা খা। যে বালক বিছানায় প্রস্রাব করে তাকে একটা গ্লাসে ডান হাত ডুবিয়ে পানিটা মুখের কাছে ধরে বলে, নে বানচোত এই পানি খা। আবার বিছানায় মুতলে শালা লেওড়া কাইট্যা ফেলুম মনে রাখিস। বিচিত্র রকমের মানুষ আসে। আলি কেনান তাদের রোগ শোকের বিচিত্র বিধান দেয়।
সামান্য সময়ের মধ্যে চারপাশে গুজব রটে যায় যে, আলি কেনানের রোগ সারাবার আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। খবর যতো ছড়ায়, ততো অধিক হারে মানুষ তার কাছে আসে। আগে তার কাছে বস্তির মানুষ, কাজের বেটি, রিকশাঅলা এই সব নিম্নশ্রেণীর মানুষ আসতো। এখন দ্রঘরের মানুষ, বিশেষ করে মেয়েছেলেরা তার কাছে আসতে আরম্ভ করেছে। এইসব মহিলা দেখলে তার খুব আনন্দ হয়। আবার পাশাপাশি ঘৃণার একটি কৃষ্ণ রেখাও সাপের মতো এঁকে এঁকে মনের মধ্যে জেগে ওঠে। মাঝে মাঝে তার বলতে ইচ্ছে করে,
মাগিরা ব্যারাম সারাইবার কালে আলি কেনান আর মজা করার সময় অন্য মানুষ। এই সব রঙিন মাংসের পুতুল লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। আলি কেনান নিজেকে নিজের ভেতর ধারণ করতে পারে না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সে অধিকতরো অশ্লীল বাগধারা প্রয়োগ করতে থাকে। অর্থী প্রার্থীরা বিনা প্রতিবাদে তীক্ষ্ণ চোখা গালাগাল হজম করে। এমন কেউ থাকাও বিচিত্র নয় যে প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে এসব ভক্তিভরে শুনলে অর্ধেক রোগ নিরাময় হয়ে যাবে । একবার একজন জোয়ান মানুষ আলি কেনানের কানে কানে স্ত্রীর বিশ্বাসভংগের অভিযোগ করে। আলি কেনান হুঙ্কার দিয়ে বলে, শালা তর হাতিয়ারে জোর নাই। কবিলা তরে কেয়ার করবো কেরে? হের হাউস নাই? পুরুষের ছ গুণ। মাইয়া মানুষের ন গুণ। এই রকম নানা কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ গরম দরবেশ হিসেবে আলি কেনানের নাম ফেটে যায়।
আলি কেনানের কাণ্ড জ্ঞানটি ভীষণ ধারালো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সে অনুভব করে, চারদিকে তার প্রভাব যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, সমস্ত কর্মকাণ্ড একটা শক্ত ব্যবস্থাপনার মধ্যে বাঁধতে না পারলে যে কোনো মুহূর্তে চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। পাছায় লাথি মারা, ডান হাত ডুবিয়ে পানি পড়া এসব করে অধিকদূর যাওয়া সম্ভব নয়। ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত রুচির মানুষেরা তার কাছে আসতে আরম্ভ করেছে। তাদের চাহিদা, পছন্দ এবং রুচি মোতাবেক অনেক কিছু পাল্টাতে হবে। সে বেশ কিছুদিন মাথা খেলিয়ে একটা চমৎকার বুদ্ধি বের করলো। নিজের ভাবনার চমৎকারিত্বে আলি কেনান নিজেই চমকে ওঠে।
ফুলতলিতে একটা মসজিদ আছে। দুতিন জন মানুষ মাত্র নিয়মিত নামাজ কালাম পড়ে। একমাত্র শুক্রবারেই মসজিদে অল্পস্বল্প লোক সমাগম হয়। ফুলতলি গরিব মহল্লা, তাই মসজিদটিও গরিব । নিয়মিত আজান প্রচারের জন্য এক জোড়া মাইক লাগানোর সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন মুয়াজ্জিন সাহেব পাখির ডাকের মতো চিহি স্বরে, পাঁচবেলা আযান ধ্বনি উচ্চারণ করেন। সে আওয়াজ মুয়াজ্জিন সাহেব নিজের কানে শুনতে পান কিনা সন্দেহ আছে। মুয়াজ্জিন সাহেব শুকনা পাতলা মানুষ। তার গলার আওয়াজটিও অতিশয় ক্ষীণ। শুক্রবারে জুমার নামাজে ইমামতি করার দায়িত্বও তার। সে হিসেব করলো,
তাকে মুয়াজ্জিন সাহেব না বলে ইমাম সাহেব বলাই সঙ্গত। শুক্রবারে মহল্লার সর্দার সাহেব নিজে জুমার নামাজ আদায় করতে আসেন। কোনো কারণে সর্দার সাহেবের আসা বিলম্বিত হলে তার জন্য সমস্ত মুসল্লিকে অপেক্ষা করতে হয়। সর্দার সাহেবের পূর্বপুরুষেরা এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। সে কারণে সর্দার সাহেব নিজেই মসজিদের মোতওয়াল্লি। তাঁর অহংকারের অন্ত নেই। কিন্তু ইমাম সাহেবকে মাইনেটা ঠিকমতো দিয়ে উঠতে পারেন না। মাঝে মাঝে পাঁচ সাত মাস বাকি পড়ে থাকে। দেশের বাড়িতে ইমাম সাহেবের বিবি এবং বাল-বাচ্চারা আছে। তাদের দিন যে কেমন করে কাটে একমাত্র ইমাম সাহেবই বলতে পারেন। তিনি সব সময়ে আল্লাহর শোকর গুজার করেন। মাইনের কথা উঠালেই সর্দার সাহেব তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। এনিয়ে তাকে কখনো উচ্চ বাচ্য করতে দেখা যায়নি। এই মসজিদের চাকুরি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা তার মনে স্বপ্নেও উদয় হয়নি। অথচ ইমাম সাহেব সিকি মাওলানা কিংবা আধা মাওলানা নন। তিনি হাম্মাদিয়া ওহাবী মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাশ করেছেন। একেবারে পাক্কা সার্টিফিকেট আছে।
আলি কেনানের মাথায় খেলে গেলো মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে একটা ব্যবস্থায় আসতে পারলে তার লাভ এবং ইমাম সাহেবেরও লাভ। আলি কেনান আরবী ফাঁসির বিন্দু বিসর্গ জানে না। তাবিজ কবজ না দিলে আর চলছে না। তা ছাড়া শরিয়তের বিষয়ে সে একেবারে অজ্ঞ। এই পেশায় যখন চলে এসেছে, কখন কি ঘাপলা লাগে বলা তো যায় না। সুতরাং এরকম একজন মানুষ হাতের মুঠোর মধ্যে থাকা ভালো। বিপদে আপদে কাজে আসতে পারে।