একদিন আদায়ে বের হবার সময় কুকরি ছানাটিকেও সঙ্গে নিয়ে যায়। এই বিচিত্র জন্তু দর্শন করে শহরের শিশুরা তার পিছু পিছু অনুসরণ করে, হাত তালি দেয়। দেখা গেলো কুকুর ছানা নিয়ে যাওয়ার একটা বাস্তব সুবিধেও আছে। দোকানদারদেও আর তর বাপরে… বলে জানান দিতে হয় না। ঘণ্টির শব্দ শুনে সকলে আপনি মনোযোগী হয়ে ওঠে। আলি কেনান রোজ সকালে একটু বেলা করে কুকুর ছানাটি সঙ্গে নিয়ে শহরের পথে হেঁটে যায়। টুংটুং ঘণ্টির আওয়াজ হয়, লোকজন পিছন পিছন হল্লা করে। নতুন একটা চমৎকার জীবন লাভ করে কুকুর ছানাটি মাঝে মাঝে আনন্দে নেচে উঠে। আলি কেনানের অসম্ভব ভাল লাগে। তবে এই নতুন জীবনের সঙ্গে গভর্ণর সাহেবের জীবন বিনিময় করতে সে রাজি হবে না। গর্বে তার চোখে জল এসে যায়। কোনো মানুষের সাহায্য ছাড়া এই নতুন জীবনটিকে আপন প্রাণের ভেতর থেকে ফুঙ্কার দিয়ে মন্ত্রবলে জাগিয়ে তুলেছে।
কিছুদিন পর তার মনে অন্যরকম একটা ভাবনা আসে। এভাবে রোজ রোজ কুকুর নিয়ে ঘুরলে লোকজনের চোখে ওজন কমে যেতে পারে। এতোকাল ঘুমের মধ্যে ছিলো, এদিকটা সে চিন্তা করেনি। সে অনুভব করলো একজন কাউকে প্রয়োজন যে শিকল ধরে সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটিকে নিয়ে যেতে পারবে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা বহাদুর শাহ পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছিলো। সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। পুরো নওয়ারপুর এলাকাটা চক্কর দিতে হয়েছে। আলি কেনান ভেবেছিলো পার্কে ঢুকে একটু জিরিয়ে নেবে। ঢুকেই দেখতে পেলো, একটা ছেলে লম্বা হয়ে পাথরের বেঞ্চির ওপর ঘুমিয়ে আছে। পরনের জামাটি শতছিন্ন । ক্লিষ্ট মলিন মুখ পেটের চামড়া গিয়ে পিঠে লেগেছে। কতদিন খায়নি কে জানে! এরকম কতো ছেলেই তো এভাবে শুয়ে থাকে। আলি কেনান হাঁক দিলো, এ্যাই শালা চোর। ছেলেটি ভয়ে ভয়ে শোয়া থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে বললো :
মুই চোর নই। মোর বাপ মাকে তালাক দিয়া আবার হাঙ্গা বইছে। হের লাইগ্যা মুই বাপের উপর রাগ কইরা চইল্যা আইছি। চাইর দিন কিছু খাইনাই। আন্নে মোর বাবা, মোরে দুগা খাইবার দেন। আলি কেনান জানতে চাইলো,
তোর বাড়ী কই শালা?
মোর বাড়ি হাতিয়া। ছেলেটি ভীষণ ভয় পেয়েছে। কিন্তু দুটো খাওয়া পাওয়ার আশাও ছাড়েনি। আলি কেনান বললো, শালা তুই চোর । ছেলেটি তার পায়ের উপর আছার খেয়ে বললো, মুই চোর নই । মোর পেটে ভুখ।
আলি কেনান নির্দেশ দিল,
শালা খাড়াইয়া কথা ক। ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায়। আলি কেনান তার হাতে কুকুরের শিকলটি ধরিয়ে দিয়ে বললো, শালা চল। সেদিন থেকে আলি কেনানের পেশায় সহায়তা করার জন্য কুকুর ছানার পাশাপাশি একটি মানব শিশুও তার সঙ্গে যোগ দিলো।
৩. আলি কেনানের সম্প্রসারণশীল কল্পনা
আলি কেনানের সম্প্রসারণশীল কল্পনা ঝর্ণাধারার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে করতে আরম্ভ করেছে। তার আকাঙ্খ অনেক। আপাততঃ সে গুটিকয় খুচরো কাজে মনোযোগ দিতে আরম্ভ করেছে। ফুলতলির বাঁধানো কবরের পাশে একতলা বাঁশের ঘরটি নাম মাত্র মূল্যে ভাড়া নিয়ে তাতে পার্টিশন লাগিয়ে একটা হুজরাখানা প্রতিষ্ঠা করেছে। পার্টিশনের অপর পাশে কুকুর ছানাসহ ছেলেটি ঘুমোয়। এই সমস্ত কাজে খরচ করবার মতো টাকা আলি কেনানের হাতে আছে। উদ্যোগী মানুষকে সবাই সাহায্য করতে আসে। মহল্লার মানুষেরা ইতিমধ্যে নানা ব্যাপারে তার কাজে হাত লাগাতে ছুটে এসেছে। এলাকায় আলি কেনান আসার পর থেকে দৈনন্দিন জীবন যাপনের একঘেঁয়েমির মধ্যে একটা নতুন হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে ।
আলি কেনান নতুন ভাড়া করা ঘরটিতে অভ্যাগতদের বসবার সুবিধের জন্য হোগলার চাটাই পেতে রেখেছে। ননান মানুষ এখন তার কাছে আসে। তারা সেখানে এসে অপেক্ষা করে। সে আনুমানিক সকাল আটটা পর্যন্ত হুজরাখানার মধ্যে কাটায়। আবার সন্ধ্যেবেলাও ঘণ্টা খানেক সেখানে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকে। তখন সে তার নিজের মুখোমুখি হয়। একান্ত একাকিত্বের পরিমণ্ডলের মধ্যে নিজের শক্তি সামর্থ্য অনুভব করতে থাকে। আলি কেনানের এই জীবনের স্বাদটাই আলাদা। এখন সে আর কোনো সম্রাটের সঙ্গেও ওই জীবন বিনিময় করতে রাজি হবে না। স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, চারদিকে অবারিত স্বাধীনতা। নিজেকে তার সব কিছুর নিয়ন্তা বলে মনে হয়। যতো একাকী হয় ততোই অনুভব করে সে ঈশ্বরের মতো শক্তিমান। নানা জাতের মানুষ এসে হোগলার চাটাইতে বসে অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করে। সংসারে রোগ শোক আছে। আছে আশা ভঙ্গের বেদনা। আল্লাহতায়ালা মাটি দিয়ে গড়েছেন মানুষ। আর সে মানুষ বড়ো দুর্বল। প্রতি মুহূর্তে কারো কাছ থেকে ভরসা আদায় করে তাকে বাঁচতে হয়। জীবন সংগ্রামে কাতর মানুষ কোথায় পাবে সর্বক্ষণ জীবনের বোঝা বইবার প্রেরণা। আলি কেনান স্বেচ্ছায় মরণশীল মানুষের বোঝা হাল্কা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তাই মানুষ আলি কেনানের কাছে আসে।
কেউ এসে বলে, তার ছেলেটি বড়ো হয়েছে, কিন্তু এখনো বিছানায় প্রস্রাব করে। বাবার দোয়া চাই।
কেউ পেটের শুল বেদনার প্রতিকার প্রার্থনা করে।
কোনো মা চোখের জলে মিনতি জানায়, তার মেয়েটি অত্যন্ত অভাগী। তিন বছর স্বামীর ঘর করেছে, এখন স্বামী নিচ্ছে না। সহায়হীনা বিধবাকে ভরণ পোষণ জোগাতে হচ্ছে। বাবা যদি এর একটা বিহিত না করেন বিধবার দাঁড়াবার স্থান নেই।