চোখের সামনে যে রেস্টুরেন্ট পড়লো, সরাসরি ঢুকে গেলো। টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বেশ গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করে বসলো, দে তর বাপরে একটা ট্যাহা দিয়া দে। আলি কেনান তার চোখদুটি ক্যাশে বসা লোকটির চোখের ওপর রাখলো। মানুষটি বেশ লম্বা চওড়া মাথায় কিস্তি টুপি এবং মুখে চিকন করে কাটা দাড়ি। লোকটি একটা বাক্যও উচ্চারণ না করে ক্যাশ খুলে একটা টাকা তার হাতে দিলো। আলি কেনানের হাত কাঁপছিলো। পা টলছিলো। শরীরের অবাধ্য স্নায়ুর আন্দোলন থামাবার জন্য তাকে কিছু একটা করতে হবে। তাই বললো,
আল্লাহ, তরে অনেক দিব।
এভাবে প্রথম দিনেই সে তেরো টাকা সংগ্রহ করে ফেললো। প্রথম দিনের আদায় হিসাবে মন্দ না। সব দোকানদার দেয়নি। তার জন্য আলি কেনান দোকানদারদের দোষ দেয়না। নিজের অন্তনিহিত দুর্বলতাকে দায়ী করে। সে খতিয়ে খতিয়ে হিসেব করে তার গলার আওয়াজটা অস্বাভাবিক রকমের দুর্বল ছিলো। প্রয়োজনীয় জোর সে প্রয়োগ করতে পারেনি। কিংবা দোকানে এতো ভীড় ছিলো যে তার আওয়াজ মালিকের কানে পৌঁছুতেই পারেনি। কালে কালে এসকল ছোট খাটো দোষত্রুটি সংশোধন করে নেয়া যাবে। মানুষতো তাকে টাকা দেয়ার জন্য বসেই আছে। সে নির্দেশ দিতে জানে। এমন নির্দেশ দিতে হবে যাতে অন্তরাত্মা পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলতে পারে। আলি কেনানের সৃজনী শক্তি আছে, একথা স্বীকার করতে হবে। সে ভেবে দেখলো এই দরবেশী জীবনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নেয়ার মতো একটা আশ্রয়ও খুঁজে বের করতে হবে। কথায় বলে আস্তানা না পেলে মস্তান হয় না। ফুলতলির ওদিকে গতকাল সে একটা বাঁধানো কবর দেখেছে। চারপাশের দেয়ালের ঘেরটা বেশ বড়ো। অনায়াসে একজন মানুষের ঘুমোনোর পক্ষে যথেষ্ট। ঝড়বৃষ্টি হলে অসুবিধে হতে পারে। হ্যাঁ তা একটু হতে পারে বৈকি। তবে এখন আশ্বিন মাস। নীল নির্মেঘ আকাশ, আরামসে আলি কেনান এখানে রাত কাটাতে পারে। আর ভাগ্য যদি প্রসন্ন হয় কালে কালে একটা চালা উঠিয়ে নেয়া অসম্ভব নাও হতে পারে। সেই রাত থেকে আলি কেনান ফুলতলির কবর স্থানে বসবাস আরম্ভ করে দেয়। যারা দেখেছে এক আধটু কৌতূহলী হয়ে তাকিয়েছিলো কোনো প্রশ্ন করেনি। এ ধরনের ঘটনাতে হামেশাই ঘটে। দরবেশ ফকির ওরা তো সবখানে মাটি খুঁড়ে জন্মায় আর মানুষ তাদের মেনে নিতে অভ্যস্ত। একটা বখাটে ছেলে শুধু বলেছিলো, দরবেশ বাবা যতোদিন ইচ্ছা থাকবার পারবা, আমাকে মাসে মাসে পঁচিশ ট্যাহা খাজনা দেওন লাগবো। আগে বাগে কয়্যা রাখলাম। তুই কুন গাঞ্জাখোর বেটা ট্যাহা চাস? আলি কেনানও সমান তেজের সঙ্গে জবাব দিয়েছে, না ঠেকলে চিনবার পারবিনা আমি কে? ছেলেটি প্রায় তেড়ে এসে বলেছিলো, তোর দওবেশগিরি পাছা দিয়া হান্দাইয়া দিমু। এই হানে থাকতে অইলে মাসে মাসে পঁচিশ ট্যাহা দেওন লাগবো। এনিয়ে আলি কেনানের সঙ্গে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। আরেকটি যুবক হস্তক্ষেপ করায় অধিক দূর গড়াতে পারলো না। হাত ধরে ছেলেটিকে নিবৃত্ত করে বললো,
আবে কালাচান, আল্লাহ কার ভিতরে কি মাল ভইরা থুইছে কইবার পারবি? এটা তো নতুন কোনো কথা নয়, চোরগুন্ডারা ফকির দরবেশকে বেশী ভক্ত করে। সুতরাং আলি কেনান ফুলতলির বাঁধানো কবরটিতে পাকা ঠিকানা পেতে বসলো। আলি কেনানের বিচরণ ক্ষেত্র অনেক দূর বিস্তৃত হয়েছে। কোনো কোনো দিন সে বাংলা বাজার সদরঘাট অঞ্চলে টাকা তুলতে যায়। কোনোদিন কমলাপুর, আবার কোনো দিন নওয়াবপুর। টিপু সুলতান রোড হয়ে নারিন্দা অবধি সমস্ত এলাকাটিকে সে তার নিজের জমিদারি বলে মনে করতে আরম্ভ করেছে। একেকটি এলাকায় সে পনেরোদিন অন্তর একবার দর্শন দেয়। পূর্বের মতো টেবিলে থাবা দিয়ে বলতে হয় না, ‘তর বাপরে একটা ট্যাহা দিয়া দে।’ এখন তার দাবি করার পদ্ধতিটাও অনেক সহজ হয়ে পড়েছে। যে শুধু তার উপস্থিতিটুকু জানিয়ে দেবার জন্যে উচ্চারণ করে, তর বাপরে…। বাক্য ব্যয় না করে দোকানদার একটি টাকা এগিয়ে দেয়। কেউ কেউ বেশীও দেয়। সে আপত্তি করে না, কিন্তু এক টাকার কম অর্থ আলি কেনান গ্রহণ করে না।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আলি কেনানের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। সে কবরের চার কোণে চারটি ত্রিকোণাকার লাল নিশান টাঙিয়েছে। কবরটিকে আপাদমস্তক লাল শালুতে ঢেকে দিয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালায়। কবরের এই আকস্মিক শ্রীবৃদ্ধিতে কিছু কিছু গাঁজাখোর, চণ্ডু খোর ভীড় করতে আরম্ভ করেছে। আলি কেনান লাল শালুর একটা লুঙ্গী এবং একটা আজানুলম্বিত আলখাল্লা বানিয়ে নিয়েছে। গলায় বড় বড় দানার কাঠের মালা পরেছে। দুটি লোহার শেকল কাঁধের পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে কোমর অবধি ঝুলিয়ে দিয়েছে। এখন মাঝে মাখে তার জজবার ভাব হয়। সে সময়ে আলি কেনান অনেকটা ভাবের আবেশে কি গাঁজার নেশায় বলা মুশকিল, গেয়ে ওঠে :
হেই মানুষ জনম গুনাহগার
ভবনদী কেমনে দিবি পার
সময় থাকতে গুরুর পন্থা ধর
বাবা বু আলি কলন্দর
বাবা বু আলি কলন্দরা।।
একদিন আলি কেনান লক্ষ্য করে একটা কুকুর ছানা কুই কুঁই করে কবরের চারপাশে ঘুরছে। পয়লা তার ইচ্ছে হয়েছিলো হারামজাদা কুত্তার বাচ্চাটার একটা ঠ্যাং ল্যাংড়া করে দেয়। কুত্তার বাচ্চার দুঃসাহস তো কম নয়। পরক্ষণে তার মনে একটা মৌলিক ভাবনা জন্মায়। জখম না করে কুকুর ছানাটিকে একটু করো পাউরুটি খেতে দেয়। এভাবে দুচারদিন যেতে না যেতে কুকুর ছানাটি তার ভীষণ ন্যাওটা হয়ে পড়ে। প্রতিদিন সে নদীতে গোসল করতে যাওয়ার সময় কুকুরছানাটিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। আপন হাতে রগড়ে রগড়ে সারা গা পরিষ্কার করে। একদিন বাজার থেকে লাল এবং সবুজ রঙের গুড়ো কিনে আনে। একটা গামলাতে সে রঙ ভাল করে গুলে নিয়ে কুকুর ছানাটির পিছনের দিকে সবুজ এবং সামনের দিকে লাল রঙ লাগিয়ে দেয়। তখন শিশু কুকুরটিকে আশ্চর্য সুন্দর দেখাতে থাকে। আলি কেনান একদৃষ্টে নিজের শিল্প কর্মের দিকে তাকিয়ে থাকে। আশ মেটে না। আবার দোকানে যেয়ে সুন্দর পেতলের শিকল এবং ঘণ্টি কিনে আনে। চামড়ার বেল্টের সঙ্গে জুড়ে আটটি ঘণ্টি গলায় ঝুলিয়ে দেয়। কুকুরটি চলতে ফিরতে টুং টুং আওয়াজ করে। এই ছোট্ট শিশু জন্তুটির এত সব ছলা কলা দেখে আলি কেনানের আনন্দ আর ধরে না।