এই কুত্তার বাচ্চা টেলিফোন দিতে এতো দেরী করলি ক্যান। পিএ ভদ্রলোক অত্যন্ত স্র স্বভাবের মানুষ। কেউ কঠোরভাবে কথা বললে যথাসম্ভব মার্জিত জবাব দেয়াটাই তার অভ্যেস। তিনি বললেন, স্যার আমি প্রথম থেকেই আলি কেনানকে অনুরোধ করে আসছিলাম। সে বারবার বলেছে আপনাকে ডেকে দিতে পারবে না। তাই শেষ পর্যন্ত আপনার বেডরুমে ঢুকে পড়তে হলো। স্যার এ বেয়াদফী মাফ করে দেবেন। আচ্ছা তুমি যাও এবং এডিসিকে আসতে বলে। এডিসি এলে গভর্ণর সাহেব রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে নির্দেশ দিলেন, এই কুত্তার বাচ্চা আলি কেনানকে এখখুনি ঘাড় ধরে বের করে দাও। সংক্ষেপে এই হলো আলি কেনানের স্বর্গ থেকে পতনের কাহিনী।
২. গভর্নর হাউজ থেকে রাস্তায়
সে দিন সন্ধ্যেবেলা গভর্নর হাউজ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আলি কেনানের মনে হলো বিগত একটা বছরের জীবন সে যেনো স্বপ্নের মধ্যে কাটিয়েছে। সে ছিলো ভোলার তামাপুকুর গ্রামের এক অখ্যাত অভাজন আলি কেনান। গভর্ণর হাউজের সু উচ্চ গম্বুজের দিকে তাকিয়ে তার অবাক লাগে কি করে এই আলিশান অট্টালিকায় প্রবেশ করে গভর্ণর সাহেবের সবচেয়ে পেয়ারের মানুষ হয়ে উঠেছিলো। গল্পের মতো মনে হয়, স্বপ্নের মতো লাগে।
তার সেদিনটির কথা মনে পড়ে গেলো; যেদিন গাঙের গভীর পানি থেকে পাঁজা কোলা করে ডুবন্ত গভর্ণর সাহেবকে ডিঙ্গিতে উঠিয়ে নিয়েছিলো। আলি কেনানেরা সাত ভাই যদি সেদিন জানের ঝুঁকি নিয়ে গভর্ণর সাহেবকে বাঁচাতে ছুটে না আসতো ঐ গাঙের পানিতেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হতো। আজ এ কথা কে বিশ্বাস করবে। ওই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর সাহেব তাকে চূড়ান্ত অপমান করে এক কাপড়ে বলতে গেলে একরকম. উলঙ্গ অবস্থায় শহরের মাঝখানে ময়লা আবর্জনার মতো ছুঁড়ে দিলেন। হায়রে আল্লা তোমার রাজ্যে এতো অবিচার! আর মানুষ এতো অকৃতজ্ঞ হতে পারে!
এখন আলি কেনানের প্রধান সমস্যা সে যাবে কোথায়? ভোলায় নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে এসেছে। কিন্তু সত্যি সত্যি ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখে তার শিরার রক্ত চলাচল একরকম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। হ্যাঁ, সে ভোলায় ফিরে যেতে পারে বটে। আর যদি ফিরে যায় মানুষ কাল হোক, পরশু হোক একদিন জেনে যাবে লাট লাহেব তাকে পাছায় লাথি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। তখন অবস্থাটা কি দাঁড়াবে? তার ভাই বেরাদরেরা যে সকল মানুষকে বিপদে ফেলেছে, শাস্তি দিয়েছে তারা তো আর বসে থাকবে না। আলি কেনানের সমস্ত কীর্তি তার চোখের সামনে খসে খসে পড়বে। সমস্ত জমি জমার পাল্টা দখল শুরু হয়ে যাবে। দুজন মানুষের লাশ তারা চরের মধ্যে পুঁতে রেখেছে। তারা জ্যান্ত হয়ে বদলা দাবি করবে। থানার দারোগা, খাশ মহালের কর্মচারী, মহকুমার এসডিও এতোকাল অনন্যোপায় হয়ে আলি কেনানের আবদার দাবি পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে। এখন সকলে পিঠ ফিরে দাঁড়াবে। আলি কেনান স্পষ্ট দেখতে পায় তার সৌভাগ্যের নক্ষত্র ডুবে গেছে। এখন তামাপুকুর গ্রামে ফিরে যাওয়া মানে এক পাল নেকড়ের মধ্যে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ানো। ভোগান্তিটা যদি শুধু একা আলি কেনানের হতে কোনো কথা ছিলো না। আলি কেনান জানে পুরুষের ভাগ্য এরকমই। কিন্তু সে চোখ মেলে দেখতে পারবে না তার বুড়ো বাপকে গ্রামের মানুষ অপমান করছে, ভাইদের কোমরে দড়ি পরছে, চাষের জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। অসহায়ের মতো এসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার বদলে আলি কেনানের মরে যাওয়া অনেক ভালো। তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে। আলি কেনান নিজেকে এতোদিন পরিবারের সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করে এসেছে। আজকে দূর্ভাগ্যের জ্যান্ত প্রতিমূর্তি হিসেবে কিভাবে আত্মীয় স্বজনের সামনে কালোমুখ দেখাবে। তার বদলে আলি কেনানের পক্ষে চলন্ত ট্রেনের নিচে আস্ত শারীরখানা পেতে দেয়া অনেক সহজ হবে। আলি কেনান যেই মায়ের পেটে নমাস ছিলো সেখানে যেমন ফেরত যেতে পারে না, তেমনি পারে না ভোলার তামাপুকুর গ্রামে ফিরে যেতে। আত্মীয় স্বজনদের অনেককেই সে ঢাকা শহরে পিয়ন দারোয়ানের চাকুরিতে বহাল করেছে। ওদের কারো কাছে যাওয়ার কথা তার মনের ধারে কাছেও ঘেঁষেনি। কেননা তাদের কাছে আলি কেনানের পজিশন ছিলো গভর্ণর সাহেব নন, স্বয়ং আইয়ুব খানের মতো। সুতরাং ওদের কাছেও সে যেতে পারে না।
গভর্ণর-হাউজে জন্মানো খোলস পরিবর্তন করে নতুন খোলস জন্মাতে মোটামুটি তিন মাসের মতো সময় লেগেছে। এরই মধ্যে আলি কেনান মেসে বসবাস করেছে। সদঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঘুমিয়েছে। শহরের পার্কে বসে বসে আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করেছে। কিন্তু আজ লঞ্চ থেকে নামা যাত্রীর কাছ থেকে টাকাটি আদায় করতে পারায় আলি কেনানের চোখে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন ভীড় করে।
আলি কেনানের মত মানুষ ভাংবে অথচ মচকাবে না। পৃথিবীতে এখনও তার বাঁচবার যথেষ্ট উপায় আছে। তার জামা কাপড় একদম ছিঁড়ে গিয়েছিলো গভর্ণর সাহেবের অনুকরণে দ্বিতীয়বার চাদেও মতো সুন্দর করে দাড়ি রাখতে আরম্ভ করেছিলো। আজ শখ, বিলাস উচ্চাকাঙ্খগুলো তাকে মুখ ভ্যাংচাতে আরম্ভ করেছে। মুখে দাড়ির জঙ্গল হয়ে গেছে। জামা কাপড় ছিঁড়ে এমন এক দশা হয়েছে ইচ্ছা করলে আলি কেনান এখন ভিখিরিদের সারিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। একটি পানের দোকানের আয়নায় আলি কেনান আরেকবার তার চেহারা সুরত ভালো করে দেখে নিলো। ময়লা ত্যানা পাজামা পাঞ্জাবি, মুখে একমুখ দাড়ি উসকো-খুসকো জট বাঁধা মাথার চুল। আগুনের ভাটার মতো জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি সব মিলিয়ে তাকে পাকা দরবেশের মতো দেখাচ্ছে। নিজেকে ঠিক ভিখিরি হিসেবে কল্পনা করার চেয়ে এ অনেক ভালো। একবার নিজের সম্পর্ক যখন নিশ্চিত হলো, কোত্থেকে সাহস এসে তাকে নতুন জীবনের পথে ছুটিয়ে নিয়ে গেলো।