সরকারি অনুমোদনের বলে কোনো বড় ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ ছাড়া তারা বিশাল ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়ে বসলো। তাদের বাধা দেয়ার মতো কোনো শক্তি ছিলো না। থানা পুলিশ মায় মহাকুমা হাকিম পর্যন্ত চোখ কান বুজে থাকতেন। গভর্ণর হাউজে আলি কেনানের প্রতিপত্তির কথা গ্রামে পঞ্চাশগুণ বেশি করে প্রচারিত হয়েছে। সত্যি সত্যি গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলো তার পরিবারের বিরাগ ভাজন হলে আলি কেনান লাট সাহেবকে বলে ফাঁসি পর্যন্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখে। গ্রামের লোকের ছিলো জানের ভয়, আর আমলাদের চাকরির। আলি কেনানের বাবা পঁয়ষট্টি বছর বয়সে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়ে গেলো। চাচাতো জেঠাতো দুভাই মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্য হয়ে বসলো। তখন তাদের আর পায় কে? গোটা ইউনিয়নের সালিশ বিচার সবকিছু করার অধিকার আলি কেনানের পরিবারের একচেটিয়া হয়ে গেলো। ঢাকার গভর্ণর হাউজের অনুকরণে ভোলা মহকুমার তামাপুকুর গ্রামে একটি ক্ষুদ্র ক্ষমতা কেন্দ্র তারা তৈরি করে ফেললো। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব যেমন ইসলামাবাদে বসে পূর্ব পাকিস্তানের শাসন কর্ম পরিচালনা করতেন। আলি কেনানও তেমনি ঢাকার গভর্ণর হাউজে বসে তামাকুপুর গ্রামের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতো।
একবার আলি কেনানের বোনের সঙ্গে কি কারণে তার ভগ্নিপতির ঝগড়া বাধে। বলাবাহুল্য, তাদের সাত ভাইয়ের বোন ওই একটিই এবং সে সকলের ছোটো। ভাইয়েরা তাকে ভীষণ আদর করতো। পিতৃ পরিবারের উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধিতে বোনটির চোটপাট ভালোরকম বেড়ে গিয়েছিলো। একদিন কি কারণে জানা যায়নি ভগ্নিপতি একটা পীড়ি দিয়ে আঘাত করে বোনের মাথাটা ফাটিয়ে দেয়। গ্রামদেশে এই জাতীয় সংবাদ প্রচারিত হতে বেশি সময় নেয় না। শুনে ভাইয়েরা লাঠি হাতে বোনের শ্বশুর বাড়ির দিকে ছুটে যায়। তাদের বাড়ি অবধি যেতে হলো না। বাজারের কাছেই ভগ্নিপতির সাথে মুলাকাত হয়ে যায়। তারা ভগ্নিপতিকে সাপের মতো পেটাতে থাকে। এদিকে বোনের কাছে খবর যায়, যে তার ভাইয়েরা এসে সোয়ামীকে পেটাচ্ছে। বোন লাজ শরম ত্যাগ করে একেবারে প্রকাশ্য রাস্তায় ছুটে . এসে ভাই এবং খসমকে মাঝখানে দাঁড়ায়। ভাইদের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। আহত সোয়ামীর দিকে তাকিয়ে তার বুঝি একটু দয়া হয়, কিন্তু ভয় দেখাতে ভুলে না। ভাইজান এই হারামীর পুতরে মাইরা হাত গন্ধ কইর্যা কি লাভ। তার বদলে বড় ভাইজানরে একখানা চিঠি লেইখ্যা দেন। ভাইজান লাট সাবরে কইলে সৈন্য আইন্যা হের সাত গুষ্ঠিরে হাগাইয়া ছাড়বো। আসলেও মানুষ বিশ্বাস করতো, আলি কেনান তামাপুকুর গ্রামে সূর্য ওঠাতে আর ডোবাতে পারে।
আলি কেনানের দিনগুলো দিব্যি কাটছিলো। এই সময়ে সে গভর্ণর সাহেবের মতো দাড়ি রেখে দিয়েছে। একটা জিন্নাহ টুপি কিনে পরতে আরম্ভ করেছে। কালো কাপড় কিনে একটা শেরওয়ানী বানিয়ে নেয়ার কথাও তার মনে উদয় হয়। কিন্তু অতোটুকু সাহস করে উঠতে পারেনি। তাছাড়াও ইদানিং মনে একটা গোপন বাসনা হানা দিতে আরম্ভ করেছে। সে স্থির করেছে, আগের সে পুরোনো বউ দিয়ে তার চলবে না। সবদিক দিয়ে যোগ্য দেখে তার আরেকটা বিয়ে করা উচিত। সর্বক্ষণ বড়ো সাহেবের সঙ্গে থাকতে হয় বলে এ আকাঙ্খটি তার অপূর্ণ রয়ে গেছে।
সকলের দিন সমান যায় না। আলি কেনান ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে অদূর ভবিষ্যতে নীল নির্মেঘ আকাশে তার জন্য বজ্রপাত অপেক্ষা করছিলো। ঘটনাটি আচমকা ঘটে গেলো।
আরেকদিন গভর্ণর সাহেব দীর্ঘ চারঘণ্টা ধরে তাঁর দলের নেতাদের নিয়ে মিটিং করার পর একটু আরাম করে নিচ্ছিলেন। আলি কেনান অন্যান্য দিনের মতো টেলিফোনের গোড়ায় বসে ঝিমুতে ঝিমুতে নতুন বিয়ে করার বিষয়টি চিন্তা করছিলো। এমন সময়ে টেলিফোনটা তরুণ বজ্রের মতো চিৎকার করে উঠলো। আলি কেনান ভীষণ বিরক্ত হলো। আজকাল সে টেলিফোন কল রিসিভ করার সময় ভীষণ বিরক্তি বোধ করে। গভর্ণর সাহেবকে টেলিফোন করে যারা তার গভীর ভাবনায় বাধার সৃষ্টি করে, মনে মনে তাদের কুত্তার বাচ্চা বলে গাল দেয়। তবু রিসিভার কানে তুলে জিজ্ঞেস করলো, কেডা? ওপাশ থেকে গভর্ণর সাহেবের পিএ জানালেন, সাহেবকেই তার চাই। আলি কেনান তার চিরাচরিত প্যাটেন্ট জবাবটাই দিলো, বড়ো সাব আরাম করবার লাগছেন। অহন কতা অইবনা।
পি এ বললো, অত্যন্ত জরুরি। ইসলামাবাদ থেকে প্রেসিডেন্ট সাহেব কথা বলবেন। আলি কেনান এই পিএটিকে দুচোখে দেখতে পারতো না। সে মনে করতো তাকে সময়ে অসময়ে বিরক্ত করার জন্যই এই পিএ বেটার জন্ম হয়েছে। সে তার গ্রাম্য কুটবুদ্ধি দিয়ে হিসেব করলো, প্রেসিডেন্ট সাহেবের টেলিফোন ফেল করিয়ে দিলে পিএ ব্যাটার চাকুরি যাবে, তার কি!
পিএ সাহেব বারবার অনুরোধ করে আলি কেনানকে রাজি করাতে না পেরে সমস্ত প্রটোকল ভেঙে গভর্ণর সাহেবের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করলো। তারতো চাকুরী এবং ঘাড় দুটো বাঁচানো প্রয়োজন। তিনি অনেকটা চীকার করেই ঘোষণা করলেন,
স্যার ইসলামাবাদ থেকে প্রেসিডেন্ট সাহেবের কল। গভর্ণর সাহেব পাজামার। রশিটি খুলে দিয়ে দিবান্দ্রিা উপভোগ করছিলেন। প্রেসিডেন্ট সাহেবের কল শুনেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পাজামার রশি বাঁধার কথাটিও ভুলে গিয়েছেন। তাড়াতাড়ি রিসিভার তুলে নিলেন। প্রেসিডেন্ট সাহেব তাঁকে কর্তব্যে গাফিলতির জন্য অনেকক্ষণ ধরে উর্দু, পশতু এবং ইংরেজি মিশিয়ে চৌদ্দ পুরুষ তুলে গাল দিলেন। গভর্ণর সাহেব থেমে থেমে ‘মাই প্রেসিডেন্ট যেয়াদা সুর হো গয়া’ শব্দ কটি উচ্চারণ করলেন। আর ওপাশ থেকে অজস্র ধারায় গালাগালির স্রোত প্রবাহিত হতে থাকলো। ঘণ্টাখানিক পরে টেলিফোন রেখে গভর্ণর সাহেব পিএকে তলব করলেন। পিএ তার সামনে এসে বলির পাঠার মতো কাঁপতে থাকে। সাহেবের মেজাজ তখন সপ্তমে। তিনি কৈফিয়ত দাবি করে বললেন,