ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি, কেবিনেটের মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ আমলা, দলের নেতা, উপনেতা সকলের সঙ্গেই সে তেজের সঙ্গে তার ভোলার আঞ্চলিক ভাষাটিতেই সওয়াল জওয়াব করতো। তার ঔদ্ধত্য কতোদূর বেড়ে গিয়েছিলো- সে সম্পর্কেও একটা কাহিনী সর্বস্তরে পরিচিতি লাভ করেছিলো। নানা জিভের ঘষায় মূল কাহিনীটায় নানা রঙ লেগেছিলো। তবে আসলে যা ঘটেছিলো তার হুবহু বয়ান এরবম :
একবার হোম মিনিস্টার ওয়াজির হোসেন গভর্ণর সাহেবকে টেলিফোন করেছিলেন । তিনি তখন খাস কামরায় আরাম করছিলেন। আলি কেনান টেলিফোন ধরে জিজ্ঞেস করলো,
হ্যালো কেডা কইতাছেন? মন্ত্রী সাহেব মনে মনে বিরক্ত হলেন। তবু বিলক্ষণ জানতেন যে রাজদ্বারে যেতে হলে দ্বারীর লাঞ্ছনা শিরোধার্য করতে হয়। আলি কেনান বললো,
সাব কি কইবার চান কন? হোম মিনিস্টার সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান এবং নরম জবানের মানুষ। তিনি কণ্ঠস্বরে একটু গুরুত্ব আরোপ করে বললেন,
আমি হোম মিনিস্টার ওয়াজির হোসেন। বড়ো সাহেবের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। তুমি লাইনটা একটু দেবে? আলি কেনান দাপটের সঙ্গে জবাব দেয়,
না সাব অহন কতা অনবনা। সাব তিনঘণ্টা মিটিঙ কইরা হয়রান অইয়া অহন একটু আরাম করবার লাগছেন। কতা অইবনা। পরে টেলিফোন করেন।
হোম মিনিস্টার ফের অনুরোধ করেন,
দেখো না বাবা আলি কেনান, কথা বলাটা আমার বড়ো প্রয়োজন।
আপনের প্রয়োজন সাব আপনের লগে। আমি কি করবার পারি । সাব বিরক্ত না করবার কইছেন । হোম মিনিস্টার শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে বললেন,
বাবা আলি কেন তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো না ।
এবার আলি কেনান চূড়ান্ত ক্ষেপে উঠলো,
সাব মিনিস্টার অইছেন আপনে, কিন্তু কুনু বিবেচনা আপনের নাই। আমি আপনের কতা রাখুম কেরে আপনে কি আমার কতা রাখছেন। চাকরিডা দিছেন আমার ভাগিনারে? যান সাবের লগে কতা অইবনা। যা পারেন, করেন গিয়া।
ওয়াজির হোসেন সাহেব আলি কেনানের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার সম্পর্কে রীতিমতো লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। গভর্ণর সাহেব কোনো আমলই দেননি। তিনি ওয়াজির হোসেন সাহেবকে ডেকে বলেছিলেন, ওয়াজির হোসেন সাহেব আপনি আলি কেনানের কথায় কান দেবেন না। সে যে কখন কি বলে আর করে তার কি ঠিক আছে? বেটা একনম্বরের পাগল। ওয়াজির হোসেন সাহেব গভর্ণর সাহেবের কথায় তুষ্ট না হয়ে বলতে যাচ্ছিলেন,
স্যার এভাবে যদি একজন পিয়ন অপমান করে, তবে…
গভর্ণর সাহেব লালচোখ মেলে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তবে কি মন্ত্রীগিরি ছেড়ে দেবেন? তারপর কিন্তু ওয়াজির হোসেন সাহেব আর কিছু বলেননি। গভর্ণর সাহেবের ভাষায় আলি কেনান ছিলো পাগল, তবে খুব হিসেবের পাগল। মন্ত্রী সেক্রেটারীদের ওপর প্রভাব খাঁটিয়ে অনেক আত্মীয় স্বজনকে সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়ে নিয়েছে। তার আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে লেখাপড়া জানা যোগ্য কেউ ছিলো না। তাই একান্ত ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কাউকে পিয়ন, দারোয়ান আরদালির ওপরে বসাতে পারেনি। কেবল ফুফাতো বোনের ছেলেটি আই এ পরীক্ষায় ফেল করেছিলো। আলি কেনানের রক্ত সম্পর্কিতদের মধ্যে এই ভাগ্নেটিই ছিলো সবচাইতে উচ্চ শিক্ষিত। ভালোমতো উপরি পাওনা আছে এরকম একটা কেরানির চাকুরীর ব্যবস্থা করবে এটাই ছিলো তার আকাঙ্খ। মিনিস্টার ওয়াজির হোসেনের দপ্তরে এরকম একটা চাকুরী খালিও ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিনিস্টার গাদ্দারি করায় ভাগ্নেটির চাকুরী হলো না। এটা আলি কেনানের একটা বিরাট পরাজয়ও বটে। তার শোধ নিতে আলি কেনান ভুলেনি।
আলি কেনানেরা ছিলো সাত ভাই। ভাইদের মধ্যে একমাত্র সেই সামান্য লেখাপড়া করেছিলো। অন্য ভাইরা চাষ করতো। ধান ফলাতে পাট ফলাতো। আলি কেনান গভর্ণর হাউজে বহাল হওয়ার আগেও তাদের সাত সাতটি হাল ছিলো। গোটা গ্রামের মধ্যে আলি কেনানের পরিবারটা ছিলো সবচাইতে সম্পন্ন এবং পরাক্রমশালী। তাদের হালের বলদগুলো ছিলো মোটা এবং তাজা। লোকে দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো। চর অঞ্চলে তাদের নিবাস। সেখানে খুন জখম দাঙ্গা হাঙ্গামা এসব নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। জরু এবং জমির মধ্যে মানুষ জরুর চাইতে জমিকে অধিক মূল্য দিতো সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার লাঠির জোর বেশি, চরের জমি তার দখলে থাকবে এটা দীর্ঘদিনের অলিখিত কানুন। আলি কেনানেরা ছিলো সাত ভাই। চাচাতো জ্যাঠাতো মিলিয়ে একডাকে পঞ্চাশজনের মতো জোয়ান মরদ তারা বের করে আনতে পারতো। যেদিকে যেতো সবকিছু কেটে চিরে ফাঁক করে ফেলতো। নিজেদের গ্রামে নয় শুধু আশেপাশের গ্রামের মানুষও তাদের চর অঞ্চলের ত্রাস মনে করতো। আলি কেনানেরা সাম্প্রতিক দাঙ্গায় দুজন মানুষকে কুপিয়ে খুন করেছে। কিন্তু সাক্ষী প্রমাণের অভাবে দারোগাকে ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করতে হয়েছে।
আলি কেনানের চাকুরী প্রাপ্তির সুযোগে তার আত্মীয় স্বজনের প্রতাপ গ্রামে হাজার গুণ বেড়ে গেলো। কারো টু শব্দটি করার যো রইলো না। আলি কেনান ভূমি রাজস্ব মন্ত্রীকে ধরে বিলকে বিল সরকারী খাস জমির বন্দোবস্ত নিয়ে ফেললো। আগেও তারা জোরে জবরে এসব জমি ভোগ দখল করতো। তবে কাজটি অতো সোজা ছিলো না। দাঙ্গা হাঙ্গামা করে দখল নিতে হতো। খুন জখম এসব ছিলো অনিবার্য ব্যাপার। অপরকে খুন করতে গেলে মাঝে মাঝে নিজেরও খুন হওয়ার ঝুঁকি সইতে হতো। থানা পুলিশ করতে হতো। মাঝে মাঝে মামলা হাইকোর্ট অবধি গড়াতো।