তাঁর হবু স্বামীকে সঙ্গে করে এক সন্ধ্যো বেলা আলি কেনানের আস্তানায় এসে পদধুলি নিলো এবং হবু স্বামীটিকেও পদধূলি নিতে বাধ্য করলো। যা আলি কেনানের কর্ণে অমৃত বর্ষণ করে, সেই প্রাণ গলানো কণ্ঠস্বরে আলি কেনানকে একান্তে ডেকে নিয়ে বললেন :
বাবা একটু খাস দিলে দোয়া করবেন। আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি। হাতে বিশেষ সময় নেই। তবু আপনার অনুমতি এবং দোয়া চাইতে এসেছি।
আলি কেনানের মনে হয়েছিলো, দুনিয়া দুটুকরো হয়ে গেছে, সূর্য নিভে গেছে। কে যেনো তার বুকে তীক্ষ্ণধার ছুরি আমুল বিধিয়ে দিয়েছে। তবু তাকে বলতে হলো,
বেটি তর উপর বু আলি কলন্দর বাবার দোয়া আছে। সব ঠিক অইয়া যাইবো।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফিরে আলি কেনান কোত্থেকে একটা রামদা খুঁজে বের করে। একটি পাথরের ওপর অনেকক্ষণ ধরে শান দিতে লাগলো। শিষ্যদের কেউ কাছে ঘেঁষতে সাহস করলো না। যদি একটা কোপ দিয়ে বসে। তারপর রামদাটি দুহাতে ঊর্ধ্বে তুলে চিৎকার করতে থাকলো : শালা, অহনও সময় আছে, তুই হেরে ছাইরা দে । হে আমার জিনিস। তুই অরে ছুঁইলে এই রামদা দিয়া তরে কুচিকুচি কইর্যা কাইট্যা গাঙ্গে ভাসাইয়া দিমু। প্রচণ্ড উত্তেজনায় ডানে বামে রামদাটি ঘঘারাতে থাকে। তারপর এক সময় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে ঢুকে।
ঘরে ঢুকে সে তোষকটা উল্টায়। তোষকের নিচে ভাঁজে ভাঁজে রাখা টাকার তোড়া। অনেক টাকা, অনেকগুলো বান্ডিল। সব একসঙ্গে জড়ো করে আবার চিৎকার আরম্ভ করে, আমার ভেস্তের হুর, আমার আসমানের চান, আমার হইলদ্যা পাখি। তুই আমার কাছে আয়। এই ট্যাহা বেবাক তর। অনেক ট্যাহা। শেখ মুজিবের ব্যাংকেও অত ট্যাহা নাই। সব তর লাইগ্যা। সব তর লাইগ্যা তুই আয়, গতরের চামড়া দিয়া তর জুতা বানাইয়া দিমু। শরীরের লউ দিয়া তর পায়ে আলতা কইরা দিমু। তুই আয়, তুই আয়। তরে ছাড়া আমার চলত না। বেবাক দুনিয়া লইয়া আমি কি করুম। তুই আয়, তুই আয়। এক সময় ক্ষিপ্তের মতো টাকার বান্ডিলগুলো একের পর এক বাইরে ছুঁড়ে মারতে থাকে।
আমার আসমানের চান নাই, আমার দিনের সুরুজ ডুইব্যা গেছে। হইলদ্যা পাখি উইড়া গেছে। আমি কাগজের ট্যাহা লইয়া কি করুম? সে হাউ মাউ করে উচ্চ শব্দে কাঁদতে থাকে। অনেকক্ষণ প্রাণফাটা চিৎকার করার পর এক সময়ে বিছানায় ঢলে পড়লো।
তাকে বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে তার শিষ্য সাগরেদরা টাকার বান্ডিলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নিজিদের মধ্যে ভাগাভাগি করে যে যার মতো রাতের অন্ধকারে কেটে পড়লো। আলি কেনানের সেবা করে কাউকে নিরাশ হতে হয়নি।
তার পরদিন ভোরবেলা পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে তার ঘুম ভাঙে। আলি কেনানের মনে পড়লো আগের রাতে সে কিছু খায়নি। মাথাটা ব্যাথায় টনটন করছিলো, দুহাতে টিপে ধরে উঠে দাঁড়ালো। তখনি তার আনুপুর্বিক সমস্ত কথা মনে পড়ে গেলো। সে দাঁত তোলার মতো ব্যথা অনুভব করতে লাগলো। জীবনের সমস্ত সাধ, সমস্ত স্বপ্ন মিটে গেছে। তবু জীবন, এ পোড়া জীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। হায়রে জীবনের বিড়ম্বনা, হায়রে জীবনের মায়া। সে কিছু খেতে চাইলো। আজ কেউ আসেনি। কি ব্যাপার। সবাই গেল কই? উঠে সবগুলো ঘর তন্নতন্ন করে দেখলো, সব খা খা করছে। একটিও জনমানব নেই। কাউকে না পেয়ে রাস্তার কাছে চলে এলো। মোড়ের দোকানে রেডিওতে শুনতে পেলো শেখ মুজিবের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। আলি কেনানের চোখের সামনে গোটা জগতটাই দুলে উঠলো। সে বিড়বিড় করে বলতে থাকলো,
শেখ মুজিবর বাঁইচ্যা নাই, আমি ঢাহায় থাকুম কেরে? হের সমাজতন্ত্র অইলনা আমি হইলদ্যা পাখিরে হারাইলাম। ভোলায় চইল্যা যামু। অই তরা আমারে লঞ্চের একটা টিকেট কাইট্যা দে।
কিন্তু তার চীৎকার হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকলো। সময় নষ্ট না করে শোবার ঘরে ঢুকে তোষকটা উল্টে পাল্টে দেখলো। অবাক কাণ্ড। একটা আধুলিও পড়ে নেই। কাল এই তোষকের তলায় থরে থরে সাজানো ছিলো টাকার বান্ডিল। আজ কিছু নেই। সব হাওয়া। মাজারে ঢুকে গলা চড়িয়ে বলতে থাকলো, হাতে একটা পয়সাও নাই। আমি ভোলায় মা বাপের কাছে ফেরত যামু কেমনে? কেমনে যামু? মাজারের ভেতরে তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো-কেমনে যামু? কেমনে যামু?…