মহিলাটি মাঝে মাঝে তার কাছে আসেন। পা ছুঁয়ে সালাম করেন। প্রাণগলানো স্বরে বাবা বলে সম্বোধন করেন। বর্তমানে মহিলার একটি মানস সংকটকাল চলছে। তিনি অনেকদিন বিলেতে ছিলেন। দেশে ফিরে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সমাজের মক্ষীরাণী হয়ে বসেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে সিগারেট খেতেন, ড্রিংক করতেন। তার অনেক ভক্ত, অনেক অনুরাগী জুটে গিয়েছিলো। তারা নিজেদের মধ্যে তার ব্যাপার নিয়ে এত ঝগড়া বিবাদ, এত হানাহানি করেছে যে খুব অল্প দিনের মধ্যেই তার পরিচিতি দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় চিত্রাভিনেত্রীর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলো। তাছাড়া মহিলার মাথায় ছিট ছিলো। আজকে যার সঙ্গে হেসে কথা বলতেন, কাল তার গালে চড় বসিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা অনুভব করতেন না।
হুঁশিয়ার মানুষেরা মহিলাকে প্লেগের মতো ভয় করতে লাগলেন। প্রেমের জাগ্রত দেবী মনে করে একদল পেছনে ছুটতে থাকলো। মহিলারা গার্হস্থ্য শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তার মুখের ওপর বাড়ির দরোজা বন্ধ করে দিতে আরম্ভ করলেন। আত্মীয় স্বজনেরা এতো দূর বিগড়ে গিয়েছিলো যে পারলে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়ে তাকে খুন করতো। ঢাকা শহর বড় শহর নয়। এখানে সকলে সকলের হাঁড়ির খবর খুব সহজে জেনে যায়। মোটামুটি পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে এই সম্প্রসারণশীল শহরটি তার ওজন বইতে পারছিলো না। এই রকমের একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে মহিলা আলি কেনানের কাছে আসতে শুরু করেন।
এখনো মহিলা আলি কেনানের কাছে আসেন। পা ছুঁয়ে সালাম করেন। তার খাস দিলের দোয়া প্রার্থনা করেন। মহিলা যেদিন আসেন আলি কেনানের অস্থিরতা ভয়ঙ্কর বেড়ে যায়। তাকে সামলাতে শিষ্যদের হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। মেয়ে সেবিকাদের পদাঘাত সহ্য করতে হয়। এক নাগাড়ে এই অবস্থা চার পাঁচ দিন ধরে চলতে থাকে। সে জন্য মহিলা এলেই তার শিষ্যকুল সচকিত হয়ে ওঠে। যদি ক্ষমতা থাকতো, আলি কেনানের সঙ্গে তাকে দেখা করতে দিতো না। বিলেত ফেরত অনিন্দ্য সুন্দরী মহিলা যাকে দেখলে পুরুষ ঘোড়া পর্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তাঁকে ঠেকানোর ক্ষমতা আলি কেনানের শিষ্যদের কি করে হবে?
এই সময়ে মহিলার সঙ্গে এক ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। এই ভদ্রলোকেরও দিনকাল তখন ভালো যাচ্ছিলো না। তাকে ছেড়ে তার স্ত্রী আর একজনের সঙ্গে আমেরিকা পালিয়েছে। তারা একজনে অন্যজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কিঞ্চিত মানসিক সান্ত্বনা লাভ করে। যথাসম্ভব গোটা শহরের সহানুভূতিহীন দৃষ্টি এড়িয়ে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করতো, সিনেমায় যেতো। কিংবা ছুটির দিনে দূরে কোথাও চলে যেতো। এভাবে তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
একদিন মহিলা ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আলি কেনানের কাছে আসেন। আলি কেনানের পা ছুঁয়ে সালাম করে ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন,
বাবা ইনি আমার বন্ধু। আপনি আমাদের খাস দিলে দোয়া করবেন। আলি কেনানের ভদ্রলোককে খুন করার ইচ্ছে জেগেছিলো। কিন্তু উপস্থিত লোকজনের সামনে তাকে বলতে হলো,
বেটি তোগো উপরে বাবা বু আলি কলন্দরের দোয়া আছে। কুনু চিন্তা নাই। সব ঠিক অইয়া যাইবো। সেদিন ঘরে ফিরে আলি কেনান চীৎকার করে বলতে লাগলো,
শালা খানকির বাচ্চা, খেয়াল রাখিস তুই কার জিনিষের উপর নজর দিছস। খুন কইরা ফেলামু। কইলজা টাইন্যা ছিড়া ফেলামু। শরীলের লউ খাইয়া ফেলামু। আজরাইল অইয়া জান কবজ কইরা ফেলামু। অক্ষম আক্রোশে সে রাতভোর হাত পা ছুঁড়ে। খাটের উপর পদাঘাত করে যায় ক্রমাগত।
মহিলা তার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুটি নিয়ে ক্রমাগত আসে। আলি কেনানকে সালাম করে। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। কানে কানে নিজেরা আলাপ করে। আলি কেনানকে এ দৃশ্য দেখতে হয়। দেখে নীরবে হজম করতে হয়। সন্ধ্যের পর ডেরায় যখন ফেরে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো অন্ধ আক্রোশে ফেটে পড়তে থাকে। যতো রাত অধিক হয়, রাগের মাত্রাও বাড়তে থাকে। তার উন্মুক্ত প্রলাপে শিষ্যদের কারো ঘুমোবার উপায় থাকে না। সে বলতে থাকে :
শালা পাটকাঠির মতন তর শরীল। তুই হেরে সামলাইতে পারবি না। তর চোখ দুইড্যা ট্যারা। কয় পয়সা তর আছে। তুই হেরে ছাইড়া দে। হে আমার। হেরে আমি রাণী বানামু। হের লগে আমি দ্যাশ ছাইড়া চইলা যামু। আর যদি তর লগে দেখি লাশ পইর্যা থাকবো- কইয়া রাখলাম।
ধীরে ধীরে আলি কেনানের সবকিছুর প্রতি আগ্রহ কমে আসতে শুরু করে। রাতের নিভৃত প্রলাপগুলো দিনের বেলাও বলা অভ্যাসে হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ জনের প্রতি আর কোনো আকর্ষণ বোধ করে না। একেকটা দিন চলে যায়, সে নিজেকে ফাঁদে পড়া পশুর মতো মনে করতে থাকে। যদি পারতো ধারালো ছুরি দিয়ে সব বন্ধন ছিন্ন করে ওই মহিলার পেছন পেছন ছুটে যেতো। তাকে আলিঙ্গন করে বলতো।
তোমাকে ছাড়া চলবে না, তুমি আমাকে নাও, আমাকে গ্রহণ করো। গ্রহণ করো এই উন্মত্ততা, এই বেদনা, এই দুঃখ, এই অস্থিরতা। মহিলা রাজী না হলে বুকে ছুরি বসিয়ে খুন করতো, তারপর নিজে আত্মহত্যা করতো।
মাসখানেক সময়ের মধ্যে সেই মহিলা ও ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের সম্পর্ক অনেক নিবিড় হয়ে এসেছে। তারা স্থির করলো বিয়ে করবে। মহিলা বিলেত ফেরত হলে কি হবে মনে কুসংস্কারের অন্ত নেই। তিনি মনে করলেন বাবার দোয়াতেই তিনি এত তাড়াতাড়ি একটা স্বামী জুটিয়ে নিতে পারলেন। বাবার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা অনেক গুণে বেড়ে গেলো।