ভদ্রলোকের সন্তানেরা আলি কেনানের নামে পাগল হয়ে উঠলো। তারা দলে দলে তার চারপাশে ভীড় জমাতে আরম্ভ করে। আলি কেনান একটা মুক্ত দুনিয়া সৃষ্টি করে নিয়েছিলো। এখানে মদ চলে, গাঁজা চলে। শিল্পী আসে, কবি আসে, সাংবাদিক আসে। সকলেই আলি কেনানকে প্রেরণার একটা গভীর উৎস হিসেবে ধরে নিয়েছে। গুজব রটেছে, ভদ্রঘরের মেয়েরাও আলি কেনানের ওখানে গিয়ে গাঁজা টানে।
শহরের এসপি আলি কেনানের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন। তিনি সেকেলে ধরনের মানুষ। তাই তাঁর আশঙ্কা হওয়া খুবই স্বাভাবিক, এভাবে চললে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে। সবদিক বিবেচনা করে তিনি আলি কেনানকে এক বিকেলে এ্যারেস্ট করে হাজতে চালান করে দিলেন। তারপর শুরু হলো হৈ হৈ ব্যাপার, রৈ রৈ কাণ্ড। হোমরা চোমরা ব্যক্তিরা তার অফিসে টেলিফোন করতে থাকেন। নিমবাগান থেকে মাঝারি ধরনের একটা মিছিল বের হলো। মিছিলকারীরা হোম মিনিস্টারের বাড়ির সামনে বসে থাকে। বাধ্য হয়ে হোম মিনিস্টারকে মিছিলকারীদের সঙ্গে দেখা করতে হয়। তিনি আশ্বাস দেন যে আজই দরবেশকে ছেড়ে দেবেন এবং অনতিবিলম্বে এসপির বদলির অর্ডার ইস্যু করবেন। একদিন পর জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসে আলি কেনান। ভক্তবৃন্দের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে,
তরা মনে রাহিস, আলি কেনান শেখ মুজিব ছাড়া আর কুনু বাপের বেটারে পরোয়া করে না। হে আমারে বুঝে, আমি হেরে বুঝি। হে সমাজতন্ত্রের তরিকার দরবেশ, আর আমি কলন্দরী তরিকার দরবেশ। এভাবে আলি কেনানের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করে কোত্থেকে একটা উৎপাত এসে তার মধ্যে একটা অন্যরকম অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এক বিলেত ফেরত মহিলা একদিন সন্ধ্যেবেলা আলি কেনানের পা ছুঁয়ে সালাম করে বললেন,
বাবা আমাকে একটু খাস দিলে দোয়া করবেন। আমি ভীষণ বিপদে আছি। আলি কেনান তাকিয়ে দেখলো, মহিলা অত্যন্ত সুন্দরী। গায়ে দুধে আলতার রং। চুল কোমর অবধি নেমে এসেছে। চোখ দুটো অসম্ভবরকম কালো এবং ভাসা ভাসা। বয়স পঁয়ত্রিশ টয়ত্রিশ হবে। তখনই আলি কেনানের মনে হলো, তার পরনে একটা নেংটি জাতীয় পোষাক ছাড়া আর কিছু নেই। মহিলার দিকে তাকিয়ে এই প্রথম অনুভব করলো, সে অর্ধ উলঙ্গ। সামনে এমন সুন্দরী এক নারী- যার কণ্ঠস্বর এমন কোমল, দৃষ্টি এতো গভীর, এরকম একটি নারীর জন্য সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে সে পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে যেতে পারে। তার ইচ্ছে হয়েছিলো মহিলার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়বে। তার ইচ্ছে হয়েছিলো মহিলাকে বলবে,
আমি চুলের জটা কেটে ফেলবো। শহরের সবচেয়ে ভালো দোকান থেকে সবচেয়ে সুন্দর দামী জামা কাপড় কিনবো। আমার অঢেল টাকা আছে। আমি তোমার সঙ্গে পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যাবো, দয়া করে তুমি আমাকে গ্রহণ করো। কিন্তু আলি কেনানকে বাস্তবে বলতে হলো,
বেটি কুনু চিন্তা করবি না, তর উপর বাবা বু আলি কলন্দরের দোয়া আছে। সব দুঃখ বিপদ আপদ কাইট্যা যাইবো। মহিলা একান্ত ভরসার চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
আমার বিপদ আপদ কেটে যাবে?
আলি কেনান বললো, হ্যাঁ, বেটি সব কাইট্যা যাইবো।
বাবা আপনার এখানে মাঝেমাঝে এলে আপনি রাগ করবেন?
বেটি তুই আমার মাইয়া, যহন মন লয়, আইবি। মহিলা পা ছুঁয়ে আলি কেনানকে সালাম করে চলে গেলেন।
সেদিন আলি কেনান তার শিষ্য সাগরেদদের অশ্লীল অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে,
শালা খানকির পুত, ভ্যাদামার বাইচ্চারা, আমারে নেংটি পিন্দাইয়া মজা লুটবার লাগছস। চোতমাড়ানীর পুতেরা। আমি তগোরে মজা দেখামু। সকলে তার কণ্ঠের অমৃত বর্ষণ শুনে কেমন জানি ভ্যাকাচ্যাকা খেয়ে যায়। আলি কেনানের কথার পিঠে কথা বলার কারো সাহস হলো না। শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছানুসারে দোকান থেকে এক জোড়া দামী পাঞ্জাবি কিনে আনা হলো। সে নিজের ঘরে গিয়েই পায়জামা পাঞ্জাবী পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুলের জটা ধরে টানাটানি করে আর গালাগাল দিতে থাকে : আমার মাথায় জটা ক্যান? খানকির পোলারা। নাপিত ডাইক্যা আন, কাইট্যা ফেলা। সিনেমার হিরোগো মতন কইরা চুল ছাইট্যা দে। সে রাতে তার সেবা করার জন্য দুটি মেয়ে গিয়েছিলো। তাদের পাছায় লাথি মেরে সে বের করে দিলো। অন্ন জল কিছুই স্পর্শ পর্যন্ত করলো না। কেবল আপন মনে আউড়াতে থাকলো, আহা কি খুবসুরত, কি দেইখলাম? গঙ্গা যমুনার পাড়ে খাড়াইয়া য্যান, দেখলাম সুরুজ অস্ত যাইতেছে। দেখলাম আন্দার রাইতে জঙ্গলের মাঝখান দিয়া চান উঠবার লাগছে। আহা কি দেইখলাম। কি খুব সুরত!
আলি কেনানের বায়না ছিলো সে সিনেমার হিরোর মতো চুল কাটাবে। শহরের সেরা দোকানের সবচেয়ে দামী পোষাক পরে মহিলার চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। তারপর তার হাত ধরে পৃথিবীর অপর প্রান্তে ছুটে যাবে। কিন্তু পরের দিনেও তাকে সেই পুরোনো পোষাকে গিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়াতে হলো। নাচতে হলো, গান করতে হলো। অসহ্য, অসহ্য লাগে আলি কেনানের। যদি পারতো তার জীবনের এই বাইরের খোলসটাকে ভেঙে চুরমার করে ফেলতো। কিন্তু পারে না। সে কম্বল ছাড়তে চায়, কিন্তু কম্বল তাকে ছাড়ে না। আসলে কম্বল নয় ওটা ভালুক। আলি কেনানের নানারকম ইচ্ছে জাগে। কখনো মনে করে সে এই মহিলাকে সবলে দুহাতে তুলে নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় ছুটে যাবে। কখনো ভাবে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মিনতি জানাবে। যে ভক্তি যে আবেগে সে বাবা বু আলি কলন্দরকে দিতে পারেনি সব মহিলাকে উজাড় করে দেবে। কিন্তু প্রতিদিন বাস্তবে ঘটে তার উল্টো।