আমাদের বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরা আইলেন, বাবাও মাজারে আইলেন। আলি কেনান মনে করলো এই তুলনা একান্তই যুক্তিসঙ্গত। তারপর থেকে আলি কেনানের চিন্তা ভাবনা সম্পূর্ণ নতুন একটি খাতে প্রবাহিত হতে আরম্ভ করলো। কাউকে বলবার সাহস তার নেই। মর্মের গভীরে ধরে নিয়েছে শেখ মুজিব জয় বাংলার নেতা এবং সে নিজে জয়বাংলার দরবেশ। এতোকাল বাবা বু আলি কলন্দর এর সঙ্গে যে কাল্পনিক সম্পর্ক সে প্রতিষ্ঠা করেছিলো এই সম্পর্ক তার চাইতে অনেক জোরালো। কেননা এর বাস্তব ভিত্তি আছে। শেখ সাহেব যেমন সব ব্যাপারে হুকুম দিচ্ছেন, তেমনি হুকুম দেয়ার অধিকার তারও আছে।
আলি কেনানের সঙ্গে পূর্বের লোকজন নেই। যা কিছু অর্জন করেছিলো, সব হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে। পরোয়া করে না আলি কেনান। মানুষের জীবনে এরকম তো কতোই ঘটে। কেউ না থাকুক না থাকুক আলি কেনানের অদম্য মনোবল আছে। দিব্যদৃষ্টি প্রসারিত করে সে দেখতে পায় সামনের সময়টা তারই। এই সময়কেই সে চাষ করবে? সময়ের গর্ভে সৌভাগ্য তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তখনকার সময়টা ছিলো ভীষণ টালমাটাল। দশ কোটি মানুষের একটা দেশের তাবত মানুষের সামাজিক বন্ধন আলগা হয়ে পড়েছে। সমাজের তলা থেকে প্রচণ্ড একটা গতিশীলতা জাগ্রত হয়ে গোটা সামাজিক কাঠামোকেই কাঁপিয়ে তুলেছে। পুরোনো যা কিছু ছিলো ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এ এমন একটা পরিস্থিতি উচ্চ চিৎকার করে না বললে কেউ কারো কথা পর্যন্ত কানে তোলে না। আলি কেনান এলাকার ছেলেদের সহায়তায় খুব সহজে একটা মাইক্রোফোন যন্ত্র যোগার করে ফেললো। এক শুক্রবার জুমার নামাজের পর ঘোষণা করে, এই বাংলাদেশে আমি আর শেখ মুজিব ছাড়া আর কুনু বাঘের বাইচ্চ্যা নাই। শেখ সাহেবের কতা যেমন হগলে হুনছে, হেইরকম আমার কতাও হুনুন লাগবো। অনেক লোক জুটেছিলো, কেউ আলি কেনানের কথার বিরোধিতা করলো না।
আলি কেনানের সাহস বাড়তে থাকে দিনে দিনে। প্রতিদিন সে মাজারের সামনের চত্বরটিতে মাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে। চীকার করে, অশ্লীল গালাগাল দেয়, কখনো খেলনা পিস্তল দিয়ে লোকজনকে ভয় দেখানোর ভঙ্গি করে। সব দিক দিয়ে সে যেনো সময়ের উপযুক্ত প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সমাজ শরীরের ভেতর যতগুলো ধারা উপধারা ক্রিয়াশীল, তার সবগুলোই যেনো জীবন লাভ করে আলি কেনানের মধ্যে ঝর্ণার বেগে ফেটে পড়তে চাইছে। আশ্চর্য, মানুষও তার এই ভূমিকাটি মেনে গিয়েছে। সকলে মনে করছে, এটিই স্বাভাবিক এবং এ হওয়াই উচিত ছিলো।
আলি কেনান অসাধ্য সাধন করতে পারে, তার চরণস্পর্শে দুরারোগ্য বাতব্যাধি সেরে যায়। মুখের ফুঁ দেয়া পানি খেলে শুলবেদনার উপশম হয়, বন্ধ্যা রমনী গর্ভবতী হয়–এমনি কতো ধরনের আজগুবি গুজব তার নামে ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ তার কাছে আসে। যখন খুশি সে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার ঝাড়ে, গান গায়, যখন খুশি নাচে। এই যুদ্ধে যে ঝোড়োশক্তি বাংলাদেশের অন্তর থেকে মুক্তি লাভ করে সর্বত্র একটা তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি করেছে সেই গন্তব্যহীন অন্ধ আদিম শক্তির সবটাই যেনো তার শরীরে ভর করেছে। যখন সে নাচে তার চোখ দুটো লাল আরো লাল হয়ে জ্বলতে থাকে। দীর্ঘল চুলের জটারা জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝড়ের পূর্বাভাস রচনা করে। শরীরের বাঁকে বাঁকে আদিম ছন্দ মূর্তিমান হয়ে ওঠে। যে দেখে চোখ ফেরাতে পারে না, সম্মোহিত হয়ে যায়।
আলি কেনান জানে না তার এই উন্মত্ততার মধ্যেও একটা নিখুঁত সাংসারিক হিসেব নিকেশ আপনা থেকে ক্রিয়া করে যাচ্ছিলো। তাকে মানুষ দরাজ হাতে টাকা দেয়। লোকজন তাকে চার পাশে থেকে সব সময় ঘিরে রাখে। মাঝখানে একটি গোলাকার বেষ্টনীর মধ্যে সে নাচে, গান গায়। সেখানে টাকা পয়সার স্তূপ জমে যায়। দশ টাকা, বিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা একশো টাকার নোট। কিছু মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে টাকা কুড়িয়ে নেয়। হিসেব করে কতো টাকা হলো। তারপর বান্ডিল বেঁধে আলি কেনানের ডেরায় পৌঁছে দেয়। আলি কেনান একেকটি বাভিল খুলে হাতের মুঠোতে যা ওঠে লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। বাকি টাকা তোষকের তলায় ফেলে রাখে। এভাবে টাকার বান্ডিল জমতে জমতে তোষকটা ওপর দিকে ফুলে ফুলে উঠতে থাকে। আলি কেনানকে কিছুই ভাবতে হয় না। তার চারপাশে আপনা থেকেই একদল ভক্ত জুটে গেছে। তারমধ্যে মেয়ে মানুষও আছে। তারা বাবার কাপড় কাঁচে, তামুক বানায়- মানে গাঁজার কল্কি সাজিয়ে দেয়। রান্না বান্না করে, গা টিপে। তাছাড়া বাবার আরো কতোরকম খেয়াল টেয়াল আছে। পুরুষ ভক্তদের কাজ একটু ভিন্নরকমের। তারা দর্শনার্থীদের সামলায়। সবাই যাতে বাবার কাছে আসতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি রাখে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এলে বাবার সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করে। টাকা পয়সার হিসেব রাখে। এমনকি কেউ কেউ গাঁজা চরশ এসব নেশার ব্যবসারও তদারকি করে।
এই সময়ের মধ্যে আলি কেনান আস্ত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেলো। জাতীয় সংবাদপত্রসমূহে অনেকগুলো সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। তাতে আলি কেনানের বিষয়ে অনেকগুলো খারাপ কথাও প্রকাশিত হওয়ায় শিষ্যেরা ঠিক করলো, এরপর থেকে তারাই সাংবাদিকদের সমস্ত খবরাখবর সবরাহ করবে, যাতে বাবার নামে এ ধরনের অপ্রচার না ঘটতে পারে। ব্রিটিশ টেলিভিশনের কোনো একটা চ্যানেল আলি কেনানের ওপর একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রদর্শন করে। সেই ফিল্মের শিরোনাম ছিলো এ ডারবিশ হু হ্যাজ ওয়ান্ডারফুল সিক্রেট হিলিং পাওয়ার। এই সংবাদ যে দিন প্রচার পেলো, আলি কেনানের গলার জড়ির মালাটি চল্লিশ হাজার টাকা মূল্যে নিলাম হয়ে গেলো।