একদিন আলি কেনান নিমবাগানের প্রভাবশালী কজন ছোকরার সামনেই শিষ্যদের কাছে বললো :
বাবা বু আলি কলন্দর আবার স্বপ্ন দর্শন দিয়া কইছেন, বিহারী আর পাঞ্জাবীরা নাপাক জন্তু। তাদের বাংলার মাটি থেইক্যা তাড়াইয়া দেওন লাগবো। সে জন্য বাবায় কইছেন জয় বাংলার নিশান নিয়ে মাজারে মাজারে যাওয়া লাগবে। শিষ্যরা বু আলি কলন্দরের স্বপ্নের ব্যাপারে কোনোদিন কোনো আপত্তি করেনি। আজকেও করলো না। আলি কেনান বললো, বাজান আরো একটি কথা কইছেন। শিকল পরা বাদ দিয়া জয় বাংলার নিশান বইতে অইবো এবং সব জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়া যাইতে অইবো। সবদিক রক্ষা পাওয়ার মতো এরকম একটি মৌলিক পরিকল্পনা তার মাথায় এসেছে, সে জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিলো।
ছোকড়াদের সঙ্গ ত্যাগ করে জয় বাংলার পতাকা এবং শেখ মুজিবের ছবি নিয়ে মাজারে মাজারে ঘুরতে আরম্ভ করলো। আলি কেনান বুঝতে পারেনি যে এই ছোকরাদের সঙ্গে থেকে তার শিষ্যদের মধ্যেও একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। মাজার পরিক্রমার দ্বিতীয় দিনে অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে তাকে আবিষ্কার করতে হলো একসঙ্গে চারজন শিষ্য কোথাও কেটে পড়েছে। অনেক খোঁজ খবর নিয়েও কোনো কুল কিনারা করতে পারলো না। এখন তার সঙ্গে শুধু ফুলতলির কিশোরটি আছে। আলি কেনান তার এই দুর্ভাগ্যের জন্য পুরোপুরি বর্তমান পরিস্থিতিকেই দায়ী করলো। রাগে দুঃখে অপমানে তার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। সে রাতে আর নিমবাগানে ফিরতে প্রবৃত্তি হলো না। মিরপুর মাজারেই রয়ে গেলো।
সন্ধ্যে গড়িয়ে গেলো। মিরপুর মাজারের সেই বুড়োটির সঙ্গে আবার তার সাক্ষাৎ হলো। বুড়ো পরিহাস মিশ্রিত ভাসায় জিগগেস করলো, অ মিয়া, দেখছি শিকল টিকল সব খুইল্যা ফেলাইছ। হাতে কি? আর বুকে ঝুলাইছ এইড্যা কি? আলি কেনান বললো :
হাতে জয়বাংলার নিশান আর বুকে মুজিবরের ফটো। বুড়ো বললো, মিয়া ভং চং ত বেশ করতাছ। টের পাইবা আর দেরি নাই।
সেটা ছিলো পঁচিশে মার্চের রাত। সে রাতেই নিথর নিদ্রিত ঢাকা নগরীর বুকে বন্দুক কামান, ট্যাংক নিয়ে প্রচণ্ড হিংস্রতায় পাকিস্তানি সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। আলি কেনান ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। সে মনে করেছিলো, পাকিস্তানি সেনা রাস্তায় মশাল জ্বালিয়ে একটা মানুষেরই খোঁজ করছে, তার নাম আলি কেনান। এক নাগাড়ে চারদিন মিরপুর মাজারে অবস্থান করতে হলো আলি কেনানকে। পঞ্চম দিন পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ ধারা একটু শিথিল হতেই সে মনস্থ করলো নিমবাগান ফিরে যাবে। ডানে বাঁয়ে খোঁজ করলো কিন্তু ফুলতলির কিশোর শিষ্যটির কোথাও দেখা পেলো না। সুতরাং একাই তাকে পথে বেরোতে হলো।
এই পাঁচদিনে শহরের কি চেহারা হয়েছে দেখে তার কান্না পাচ্ছিলো। বাড়ির ছাদে আর জয় বাংলার নিশান ওড়ে না। রাস্তায় মানুষ জনের কোনো চিহ্ন নেই। কী ভূতুড়ে পরিবেশ। এখানে ওখানে মানুষের লাশ পড়ে আছে। মিলিটারী আর সাঁজোয়া গাড়ি রাস্তায় টহল দিচ্ছে। আলি কেনান উপলব্ধি করলো শেখ মুজিবরের বারোটা বেজে গেছে। এই অবস্থা হবে সেটা সে জানতো। ফকিরনির পোলাদের নিয়ে শেখ মুজিব রাজা হতে চেয়েছিলো।
সে যখন নিমবাগান মাজারের কাছে এলো তার চোখ ফেটে পানি এসে গেলো। তার থাকার ঘর এবং জয়বাংলার অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। পোড়া মাটির গন্ধ তার নাকে এসে লাগলো। সবশেষে মাজারের ভেতরে ঢুকে আর কি হবে। উল্টোদিকে পা বাড়িয়েছিলো– পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে দাঁড়ালো। সেই পুরোনো খাদেম। চোখে প্রতিহিংসা চকচক করছে : অ মিয়া কই যাও, আইয়ো ভেড়ার গোশত খাইয়া যাও। ভেড়া পাকজন্তু, আমাগো নবী করিম ভেড়ার গোশত খাইতে পছন্দ করতেন। আলি কেনান ভালো করে তাকিয়ে দেখে শ্বেত করবী গাছের নিচে হোগলা বিছিয়ে বিশ, পঁচিশ জন মানুষ খেতে বসেছে। তাদের টুকরো টুকরো, কথা বার্তা তার কানে এলো। উর্দুতে কথাবার্তা বলছে। খাদেম মুহম্মদপুর থেকে বিহারীদের ডেকে এনে তার ভেড়া দুটো জবাই করে খাওয়াচ্ছে। আর ছমিরন বাসন পত্তর ধুয়ে দিচ্ছে। সবতো শেষ। আর কেননা, সে উল্টোদিক ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করলো। কিছু দূর যেয়ে সে দেখে একটি রোগা ঘেয়ো কুকুর তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। সেই কুকুর ছানাটি যেটাকে সে একদিন পেটে লাথি দিয়ে ফেলে চলে গিয়েছিলো।
৭. উনিশশো বাহাত্তুর সালের মাঝামাঝি
উনিশশো বাহাত্তুর সালের মাঝামাঝি দিকে আলি কেনান নিমবাগান মাজারে আবার ফিরে আসে। যুদ্ধের এই ন মাস কোথায় ছিলো, কি অবস্থায় ছিলো কেউ তা জানেনা। ভীষণ কৃশ হয়ে গেছে আলি কেনান। শরীরের মেদ একবিন্দুও নেই। তাকে চকচকে কষ্টি পাথরের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। নিকষ কালো রঙ যেনো শরীর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। চুল দীর্ঘ হয়ে জটার মতো হয়েছে। গায়ের রঙিন লুঙ্গি আলখেল্লা নেই। একটি সাদা লুঙ্গি এবং চাদর তার পরনে।
নিমবাগান এলাকার মানুষ আলি কেনানকে বীরের সম্মান দিয়েই গ্রহণ করলো। এই এলাকার মানুষের আলি কেনানের প্রতি বাড়তি এ অনুরাগ, তার কারণ আছে। আলি কেনান জয় বাংলার দরবেশ। তার অবর্তমানে এ মাজার পুরোনো খাদেম দখল করেছিলো। এলাকার লোকদের প্রতি খাদেমের একটা তীব্র বিদ্বেষ ছিলো। কেননা তারা আলি কেনানকে নানা ব্যাপারে সাহায্য করেছে। সে জন্য খাদেম সব সময় মুহম্মদপুর থেকে বিহারীদের ডেকে আনতো। এলাকাবাসীদের ভীতি প্রদর্শন করাত। রাজাকারদের আনাগোনা ছিলো নিয়মিত। নিমবাগানের মানুষ সব সময় সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকতো কখন খাদেম কি বিপদ ঘটায়। নিমবাগানের একজন প্রবীণ বললেন,