এভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে সে খুঁজে পায় না। সে অনুভব করে হাড়ে মাংসে অস্থি মজ্জায় সে ভোলার একজন লাঠিয়াল। জীবন তার কাছে একটা উৎসব বিশেষ। এভাবে সে কি করে বেঁচে থাকবে? ভেতর থেকে প্রেরণা আসছে না বলে সে এমনভাবে স্থানুর মতো বসে থাকতে পারবে না। বাইরে থেকে প্রেরণার সন্ধান করতে হবে। নিজের অন্তরের শৃঙ্খলা বাইরে আরোপ করার ক্ষমতা নেই। সুতরাং তাকে বাইরের শৃঙ্খলার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
উনিশশো উনসতুর সাল শেষ হয়েছে। সত্ত্বর সালের মাঝামাঝি অতীত প্রায়। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনটি ভীষণ বেগবান হয়ে উঠেছে। জয়বাংলা ধ্বনির একাধিপত্য গোটা দেশটিকে ঢেকে রেখেছে। সকালে জয় বাংলা, দুপুরে জয় বাংলা, সন্ধ্যেয় জয়বাংলা, এমনিক রাত্রির গভীর অন্ধকারে জয়বাংলা ধ্বনি কামানের গোলার মতো ফেটে পড়ে। যে শিশুর মুখে সদ্য কথা ফুটতে আরম্ভ করেছে, মা বাবা উচ্চারণ করার আগে জয়বাংলা শব্দ দিয়ে কথা বলা শুরু করে।
আলি কেনান চিন্তা করে দেখলো এটা একটা সময় এবং সুযোগ বটে। এই তীব্র স্রোতের খর তরঙ্গে সে ভেসে পড়তে পারে। এই প্রচণ্ড ধারাস্রোত তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাবে। এই জয়বাংলা ধ্বনির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একটা ব্যক্তিগত কারণও সে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে। গভর্ণর সাহেবকে সে একবার প্রাণে বাঁচিয়েছিলো। আর সেই গভর্ণর সাহেবই তাকে রাস্তায় উলঙ্গ করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আলি কেনানের মনের ভেতর তাঁর প্রতি একটা ঘৃণা শক্ত হয়ে জমাট বেঁধে আছে। এতোদিন সেকথা মনেই হয়নি। এখন চিন্তা করে দেখলো এই জয় বাংলার মানুষদের সঙ্গে সে যদি নেমে পড়ে তাহলে একটা প্রতিশোধও নিতে পারবে। গভর্নর সাহেব নিজেও এখন গভর্ণর হাউজে নেই। আইয়ুব তাকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা থেকে বাধ্য হয়ে নিজেও সরে গেছেন। তবু গভর্ণর সাহেব গুলশানের রাজবাড়ির মতো বাড়িতে বহাল তবিয়তে আছেন। আলি কেনানের একান্ত ইচ্ছে একবার গভর্ণর সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়াবে। বলবেন, আমার নাম আলি কেনান। একদা আপনি যাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পেছনে আলখেল্লা পরা যাদের দেখছেন। এরা সবাই আমার শিষ্য। এখন আমি জয়বাংলার দরবেশ। আমার কথায় এরা প্রাণটি পর্যন্ত বিলিয়ে দেবে। কিন্তু আপনার কথায় এই বাংলাদেশের একটা কুত্তাও ঘেউ করবে না। এই খবরটি জানিয়ে দিতে কষ্ট করে আপনার কাছে এলাম।
আলি কেনান এখন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। মনের বিমর্ষতা কেটে গেছে। তাকে ভেবেচিন্তে আর কাজ খুঁজে বের করতে হয় না। কাজ পায়ে হেঁটে তার কাছে এসে হাজির হয়। নিমবাগানের ছেলেরা মাজার প্রাঙ্গণে অফিস করছে। অধিক রাতে রাস্তায় পোস্টার লাগিয়ে কিংবা মিছিল করে আর ঘরে ফেরা সম্ভব হয় না। তাকে ডেকে বলে, দরবেশ বাবা বাড়ির দরোজা বন্ধ হয়ে গেছে। আজ রাতে তোমার এখানে ঘুমোতে হবে। আর থাকলে কিছু খেতে দাও। আলি কেনান বলে,
তরা যত ইচ্ছা খা। আর যতক্ষণ মন লয় ঘুমাইয়া থাক। বাবার দরজা তোগো লাইগ্যা কুনুদিন বন্ধ অইবো না। কেবল হপ্তায় হপ্তায় চাইল, ডাইল বাজার থন পাঠাবি। গভীর রাতে আলি কেনানের আস্তানায় রান্না চড়ানো হয়। ছেলেরা আলুর ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে তারা বেরিয়ে যায়। দুপুরে আরেক দল আসে। তারপর আরেক দল। আলি কেনানের আস্তানাটি জয়বাংলা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। সে এক রোখা স্বভাবের মানুষ। দশজনের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে কাজ করার বিশেষ অভ্যেস তার নেই। এই সমস্ত পিচ্চি পিচ্চি পোলাপান ধমক দেয়, চোখ রাঙায়। মাঝে মাঝে আলি কেনানের ধৈৰ্য্যচুক্তি ঘটে। সে সব সময় হুকুম দিয়ে অভ্যস্ত এবং হুকুম পালন করতে হলেও একজনের বেশী কর্তা সহ্য করতে পারে না। আগে গভর্ণর সাহেবের হুকুম মেনে কাজ করতে পারলে খুশি হতো। শেখ সাহেবকে সে আজকাল পছন্দ করতে আরম্ভ করেছে। কেননা শেখ সাহেব গভর্নর সাহেবের সঙ্গে টক্কর দিয়ে তাকে চিৎ করে ফেলেছেন। একটা বাঁশের মাথায় উঁচু করে শেখ সাহেবের ছবি টাঙিয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর সমস্ত কাজকর্ম মেনে নিতে পারে না।
আলি কেনান আগে গভর্ণর সাহেবকে নানা বিষয়ে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছে এবং সঙ্গত কারণেই শেখ সাহেবকেও নানা বিষয়ে পরামর্শ দেবার অধিকার আছে। কিন্তু শেখ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার ক্ষীণতম সম্ভাবনাটিও আলি কেনান দেখতে পায় না। নিজের ওপর বিরক্ত হয়। শেখ সাহেব তাকে একি পরিস্থিতির মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছেন। দুধের বাচ্চাও তাকে হুকুম করে, দরবেশ বাবা এটা করো ওটা করো। তার বর্তমান দুর্ভাগ্যের জন্য মনে মনে শেখ সাহেবকেই দায়ী করে। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে, আলি কেনান যখন তর নিজের ভিতরে নূর নাই বাইরের ধুয়া থেইক্যা নিঃশ্বাস টানতে অইবো। গোস্বা টোস্থা কইরা আর কি লাভ?
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তার একটা সাংঘাতিক অনুযোগ আছে। শেখ সাহেব জয়বাংলা করতে চান ভালো, বিহারী পাঞ্জাবিদের খেদিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চান আরো ভালো। সেই জন্যই তো আলি কেনান তাঁর দলে যোগ দিয়েছে। কিন্তু তিনি ফকিরনির পোলাদের বুকে সাহস দিয়ে এমন বেয়াদব করে তুলেছেন, এটা ঠিক না। ফকিরনির পোলারা ফকিরনির পোলাই। যেহেতু নিজেকে জয়বাংলার দরবেশ বলে ঘোষণা করেছে, তাই আলি কেনান মনে করে শেখ সাহেবের সঙ্গে রাগ, অভিমান করার অধিকার তার আছে। আলি কেনান বুঝে নিয়েছিলো ছোকরাদের মন জুগিয়ে চলা তার কর্ম নয়। তারা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে তার কোনো হদিশ নেই। সে নিয়মিত সংবাদ পাচ্ছে এখানে গুলি হচ্ছে, ওখানে ধরপাকড় চলছে। পাকিস্তান থেকে উড়োজাহাজে করে লাখে লাখে সৈন্য আসছে। কখন কি ঘটে বলা যায় না। আলি কেনান হুঁশিয়ার মানুষ। তাছাড়া মনের গভীরে এই বাঙালিদের সে মানুষ বলে মনে করে না। গভর্ণর হাউজে থাকার সময় এই একটা জিনিস তার উপলব্ধির মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো যে পাকিস্তানিরাই হলো আসল মানুষ। আর বাঙালিরা সব চুতিয়া। কেউ তাকে বলে দেয়নি। কিন্তু এই ধারণাটি তার মনে জন্ম নিয়েছে। পরিস্থিতির চাপে নিজেকে জয়বাংলার দরবেশ ঘোষণা করেছে বটে। কিন্তু জয়বাংলার মানুষদের সঙ্গে সে অধিকদূর যেতে চায় না।