তার চোখে পড়লো কালাম, জেল ফেরত দাগী আসামী কালাম কবরের ওপাশে বসে বিড়ি টানছে। আড় চোখে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। আলি কেনান বুঝতে পারে, তার চোখ আনজুমানকে তালাশ করছে। দুয়েকবার তার সঙ্গে চোখাচোখিও হলো। আলি কেনান আঁচ করতে পারে কালাম তার দিকে প্রতিপক্ষের দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে। তার অর্থ আলি কেনানের কাছে অত্যন্ত প্রাঞ্জল।
তুমি যদি মায়ের সঙ্গে ঘুমোতে পারো আমি মেয়ের সঙ্গে আশনাই করতে পারবো না কেনো? তোমার যেমন ক্ষুধা আছে, আমারও তেমনি ক্ষুধা। তোমাতে আমাতে তফাৎ কোথায়? আহা আলি কেনান এক জায়গায় কালামের সমান হয়ে গেলো। তার চাইতে মৃত্যু তার জন্য ভালো ছিলো।
মরপুর মাজারের দুই বগলে লাঠি ভর দেয়া বুড়োটির কথা তার মনে পড়ে গেলো। বুড়ো এক রাতে আপন মনে গুন গুন করে গান গাইছিলো :
‘ফকিরি সহজ কথা নয়। লম্বা চুলে তেল মাখিলে ফকিরি পাইতা নয়।‘ তার দিকে জ্বলজ্বলে চোখ মেলে তাকিয়ে বলেছিলো,
অ মিয়া ফকিরি করবার ত খুব ভঙ্গিটঙ্গি করতে আছো, ফকিরির মানে বোঝ? আলি কেনান জবাব দেয়নি। সে ফকিরির অর্থ বোঝে না। বুঝতেও চায় না। কিচ্ছু না জেনে, না বুঝে তার দিনকাল তো মন্দ কাটছে না। অধিক কি প্রয়োজন? সেই বুড়ো যাকে আলি কেনান মনে মনে ভয় পায় এবং ঘৃণা করে, কাটা কাটা ভাষায় বলেছিলো :
বাঁইচ্যা থাকার একশ একটা পথ আছে, সময় থাকতে বাইছা লও একটা। এই পথ তোমার নয়। ক্ষুরের ধারের ওপর দিয়ে চলা। তুমি পারবানা একবার পিছলাইয়া গেলে বুঝবা পরিণাম। ফকিরি অইল গিয়া মিয়া অনন্ত অসীমেরে কোলে লইয়া হগল সময় বইস্যা থাকা। আল্লারে চামড়ার চউকে কেডা দেখছে। এই অনন্ত অসীমই তো আল্লাহ। আমাগো দ্বীনের নবী মেরাজে গেছিলেন, হেইড্যা আর কিছু নয়, অনন্ত অসীমের মধ্যে লয় অইয়া গেছিলেন।
আলি কেনান মনে করে এসেছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত মাজারের পেছনে তার মতো করিতকর্মা কোনো মানুষের ফন্দিফিকির কাজ করেছে।
আসল বস্তু কিছু নেই। আজকে তার চিন্তার সীমাবদ্ধতা কে যেনো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। কিছু কিছু মানুষ দুনিয়াতে ছিলো বা এখনো আছে যারা অনন্ত অসীমকে কোলে নিয়ে জিন্দেগী কাটিয়ে দিতে পেরেছেন। এই ধরনের কিছু মানুষ দুনিয়াতে ছিলেন বলেই, আলি কেনানের মতো মানুষেরা ফন্দিফিকির করে বাঁচতে পারে। ফকিরি করার ভান করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যেতে পারে। আলি কেনান অনুভব করে অতো উর্ধ্বে ওঠার ক্ষমতা তার নেই। দুর্বল পা তাকে অতোদূরে নিয়ে যেতে পারবে না। তার কাদার পা।
একদিন বিহান বেলা ছমিরনের কান্নার শব্দ শুনে তার ঘুম ভাঙে। মেয়ে মানুষটি বুক চাপড়ে কাঁদছে :
হায়রে আল্লাহ আমার এত বড় বাশ কেডা করলো। আমার নাবালেগ মাইয়ারে যাদুটোনা কইর্যা কেডা লইয়া এলো।
আলি কেনান বুঝতে পারে, কালাম, হ্যাঁ কালামের কাজ। ঐ হারামজাদাই ছমিরনের মেয়েটি নিয়ে ভেগেছে। প্রথমে তার ভীষণ রাগ হলো।
কালামকে চরম শাস্তি দেয়ার সংকল্পে তার হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। আনজুমনকে সেদিন দেখার পর থেকে তার রক্তে রক্তে একটা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছিলো। তবে একটা বিষয় বিবেচনা করে মনকে সংযত করতে হলো। আনজুমনতো তারই বাড়ির পোষা মুরগি। এক সময়ে আপনা থেকেই তার হাতে এসে পড়বে। একটা বিরাট পরাজয় তার ঘটে গেলো। চীকার করে আকাশ পাতাল তোলপাড় করার মতো ভাবাবেগ তার মনে জন্মেছিলো। কিন্তু অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে চুপ করে থাকলো।
আলি কেনানের তীক্ষ্ণ ঘ্রানশক্তি দিয়ে বুঝে ফেললো, তার ক্ষয় শুরু হয়েছে। এই ফুলতলিতে থাকলে সে আর পতন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাকে নতুন জায়গা খুঁজে বের করতে হবে এবং যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। স্বভাবতই নিমবাগানের চিন্তাটাই তার মনে এলো। বেলা বাড়লে শিষ্যদের ডেকে বললো,
কলন্দরি বাবা খোয়বে আইস্যা কইয়া গেছেন, ই হান থাইক্যা দুই দিনের মধ্যে নিমবাগানে চইল্যা যাইতে অইবো। সে কথা না বাড়িয়ে চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েই বসলো। শিষ্যেরা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানে বু আলি কলন্দর বাবার নির্দেশ হেরফের করবার উপায় নেই। একমাত্র ছমিরনই বুঝতে পারলো আলি কেনান পালাচ্ছে। এ ছাড়া তার আর উপায় কি? দুদিন বাদে আনজুমন আর কালামের কথা উঠবে। নাড়াচাড়া পড়ার আগেই কেটে পড়ছে। সে কি করবে? হ্যাঁ তাকেও যেতে হবে বৈকি। বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু আলি কেনানের সঙ্গে সে নিশির অদৃশ্য বাঁধনে আটকা পড়েছে। সেখান থেকে পালাবে কোথায়?
৬. নিমবাগান মাজার
নিমবাগান মাজারে এসে আলি কোন নতুনভাবে গুছিয়ে নিতে আরম্ভ করেছে। মাজার প্রাঙ্গণেই একটা বড়োসড়ো চালা ঘর উঠিয়ে নেয়। নাম ফেটে গিয়েছিলো। তাই বেড়ার ঘরে টিনের ছাউনি দিতে বিশেষ অসুবিধে হলো না। নিমবাগান মোটামুটি সম্পন্ন এলাকা। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা খোরাসানি বাবার মতো ওরশটিকে আলি কেনানের একটা বিশেষ কেরামতি বলে ধরে নিয়েছে। সুতরাং আলি কেনানের কোনো দাবি, কোনো অভাব তাদের কাছে অপূর্ণ থাকার কথা নয়।
এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা আলি কেনানের শরীরে ভর করেছে। গায়ে গতরে মেদও জমতে আরম্ভ করেছে। সর্বক্ষণ তার হাসফাঁস লাগে, কিন্তু নিমবাগানের অধিকাংশ মানুষ আলি কেনানের এই আকস্মিক শারীরিক পরিবর্তনকে তার পবিত্রতার চিহ্ন বলে মনে করতে থাকে। এটাও খুব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। এই দেশের অলস নিষ্ক্রিয় মানুষেরা সবসময়ে সাধুপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। কিন্তু আলি কেনানের মনের ঝড় থামে না। মিরপুর মাজারের বুড়ো মানুষটির কথা তার মনে হানা দিয়ে জাগ্রত হয়। তার ভেতর একটা আলো ছিলো। খুব নির্জন মুহূর্তে সে অনুভব করতো, ধোঁয়া বাষ্পের গভীরে অন্তরে ঘৃতের প্রদীপের মতো কি একটা জ্বলছে। এখন সে অনুভব করে সে আলোটা আর তার ভেতরে নেই। নতুন কর্মের প্রেরণা তাকে আর তাড়িত করে না। চোখের জলে তাকে স্বীকার করতে হয়, মানুষের মধ্যে আসমানের মতো উঁচু, পর্বতের মতো দৃঢ় কতিপয় বস্তু আছে, সারা জীবন সন্ধান করলেও সেগুলোর নাগাল সে পাবে না। সে গর্তের জীব গর্তের ভেতরই তাকে থাকতে হবে। তবু আলি কেনান ভেবে অবাক হয়, তার মতো মানুষের মনেও এক সময় অমর হওয়ার বাসনা মুকুল মেলেছিলো। আহা তার জীবনের বসন্ত শেষ হয়ে গেছে। অন্তরের আলোতে পথকেটে চলা তার পক্ষে অসম্ভব। এখন থেকে লাঠির ওপর ভর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। নিজেকে ভারবাহী পশুর মতো মনে হয়। একেকটা দিন আসে আর যায়। সে জড়পিণ্ডের মতো পড়ে থাকে। আগে অন্তর থেকে সে পেতো কর্মের প্রেরণা। সেই প্রেরণার বলে বাইরের জগতে তরঙ্গ সৃষ্টি করতো। অন্তরের আগুন ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতো। সে আগুনে আত্মাহুতি দেয়ার জন্যে ছুটে আসতো মানুষ। আলি কেনানের জীবন ধারণের সমস্ত উল্লাস অবসিত হয়ে এসেছে।