আলি কেনান থাকতো আলিশান বাড়িতে। সে ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর সাহেবের একেবারে খাস পিয়ন। নামে পিয়ন বটে, কিন্তু দাপট ছিলো ভীষণ। গোটা গভর্নর হাউসে মাননীয় গভর্নরের পরে আলি কেনান ছিলো সবচাইতে শক্তিশালী মানুষ। তার কাছ থেকে ছাড়পত্র না পেলে কারো পক্ষে গভর্ণর সাহেবের কাছে পৌঁছার অন্য কোনো পথ ছিলো না। আলি কেনানের নাম সেই সময়ে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠির বিভিন্ন মহলে রীতিমতো জল্পনা-কল্পনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আলি কেনান সুন্দর চেহারার মানুষ ছিলো না। গলার আওয়াজটিও ছিলো ভীষণ কর্কশ। তার চেহারা সুরত কথাবার্তায় কোনো লালিত্য, কোনো কোমলতার লেশ পর্যন্ত ছিলো না। তাকে ডাকাতের মতো দেখাতো। সাধারণতঃ সে হাসতো না। হাসতে দেখলে মনে হতো ভেতর থেকে ঠেলে ঠেলে ইতরতা প্রকাশ পাচ্ছে। আলি কেনানের মতো এমন একজন মানুষ কোন্ বিশেষ গুণে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণরের এমন পেয়ারা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তা একটা রহস্য হয়ে উঠেছিলো। কেউ কেউ তাকে নব্য রাশপুটিন বলে মনে করতো।
আলি কেনান সম্পর্কে নানাজনে নানা কথা বলতেন। তার মধ্যে যে গল্পটি সর্বাধিক পরিচিত লাভ করেছিলো সেটি এ রকম :
একবার গভর্ণর সাহেব ভোলা শহরে মিটিং করতে গিয়েছিলেন। মফস্বলের ছোট্টো মহকুমা শহর। লঞ্চ পাড়ে ভেড়ানোর মতো কোনো জেটি ছিলো না। লঞ্চকে নদীর একরকম মাঝখানে থামতে হতো। যাত্রীরা নৌকোয় করে ডাঙ্গায় উঠতো। মহকুমা প্রশাসন গভর্ণর সাহেবের মতো মানুষের জন্যে কূলে নামার কোনো দ্র ব্যবস্থা করতে পারলো না। তাই লঞ্চ থেকে গভর্নর সাহেবকেও একটি বড়ো সরো নৌকোয় উঠে যেতে হলো। তিনি একা ছিলেন না, তার সঙ্গে ভোলা থেকে নির্বাচিত মাননীয় গণপরিষদ সদস্যও ছিলেন। সদস্য সাহেব রোদ চড়া থাকায় গভর্ণর সাহেবের মাথার ওপর ছাতা মেলে ধরেছিলেন।
সেটা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির কাল। রাজনৈতিকভাবে গভর্নর সাহেবের দিনকাল খুব সুবিধের যাচ্ছিলো না। সর্বত্র সরকার বিরোধী আন্দোলন বেশ জোরালো হয়ে উঠেছিলো। এই ভোলা শহরেও তাঁকে বাধা দেয়ার জন্য এতো মানুষ সমবেত হতে পারে, সে কথা আগাম চিন্তা করলে তিনি একটু প্রস্তুতি গ্রহণ করেই আসতেন। তিনি তো লঞ্চ থেকে নেমে তীরের দিকে যাবেন। তীরে তাকে বাধা দেয়ার জন্য এতো জনতা সমবেত হয়েছে, মানুষের সেই জমায়েত দেখে মহকুমা শহরের অল্পস্বল্প পুলিশের ভয়ে জড়োসড়ো অবস্থা। তারা জনগণের আক্রমণ থেকে গভর্ণর সাহেবকে উদ্ধার করার বদলে নিজেরা কিভাবে পালিয়ে আত্মরক্ষা করবে, সে প্রচেষ্টায় ব্যস্ত ছিলো। ওদিকে গভর্ণর সাহেব নৌকায় উঠে বসেছেন। ডাঙ্গার মানুষ বাঁশ, কাঠ, ইট পাটকেল যা হাতের কাছে পাচ্ছে গভর্ণর সাহেবের নৌকোয় দিকে ছুঁড়ে মারছে। ভোলাতে গভর্ণর সাহেবের নিজের দলের মানুষ কম ছিলো না। ওই প্রাণ বাঁচানোর দায়ে তাদেরও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে হচ্ছিলো। মহকুমা হাকিমের করবার কিছু ছিলো না। তিনি গুলি করার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই ছিলো বেশি।
গভর্ণর সাহেবতো নৌকায় উঠেছেন। ডাঙ্গা থেকে অবিরাম ইট পাটকেল ছুটে আসছে। লঞ্চে ফেরত যাবেন সে উপায়ও নেই। মাঝি মাল্লারাও সবাই জখম হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে কপালে একটা ভাঙ্গা ইট লেগে তিনি নিজে জখম হয়ে গেলেন। কারো কারো মতে তিনি নদীতে মাথাঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। গণ পরিষদের সদস্য সাহেব ভোলার মানুষ, গাঙ তার কাছে পান্তা ভাত। ছাতাটা ফেলে দিয়ে মাত্র একটা ডুব দিয়ে মাথা বাঁচাতে তাঁর কোনো কষ্টই হয়নি। সেইদিনই গভর্ণর সাহেবের সলিল সমাধি ঘটে যেতে পারতো।
আলি কেনানরা তিন ভাই মাছ ধরা ডিঙি নৌকায় চড়ে ঘরে ফিরছিলো। গভর্ণর সাহেবের এতবড় বিপর্যয় দেখে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ডিঙিতে উঠিয়ে নেয়। তারপর জনতার ইট পাটকেল অগ্রাহ্য করে তড়িৎ গতিতে নৌকা চালিয়ে গভর্ণর সাহেবকে কোলে করে ডাঙ্গায় নামায় এবং পুলিশ বেষ্টনির ভেতর নিয়ে আসে। গভর্ণর সাহেব ফেরার সময় আলি কেনানকে সঙ্গে করে ঢাকা নিয়ে আসেন। ঢাকায় এসে ভোলার সমস্ত পুলিশ অফিসারদের বরখাস্ত এবং মহকুমা হাকিমের বদলির নির্দেশ দিয়ে বসেন। আর আলি কেনানকে খাস পিয়ন হিসেবে গভর্নর হাউসে পাকাঁপোক্তভাবে বহাল করেন।
সেই থেকে আলি কেনান গভর্ণর সাহেবের প্রিয় সখা পিয়ন যাই বলা হোক না কেনো, সবচাইতে সর্বশক্তিমান ব্যক্তির দ্বিতীয় সত্তা হিসেবে ষোলকলায় বাড়তে থাকে। গভর্ণর সাহেব মফস্বলে সফরে যাওয়ার সময় তার বাক্স পেটরা গুছিয়ে দিতো আলি কেনান। পানের সঙ্গে জর্দা এবং জয়পুরি মশলা ঠিকমতো নেয়া হয়েছে কিনা সে হিসেব রাখতো। গভর্ণর হাউজে বেয়ারা, খানসামা, আরদালির অন্ত ছিলো না। কিন্তু আলি কেনানের পজিশন ছিলো আলাদা। তার ডাকে সবাই বলির পাঠার মতো থর থর করে কাঁপতো। সে গভর্ণর সাহেবের খাওয়ার সময় ঠায় দাঁড়িয়ে সাহেবের খাওয়া দেখতো। গভর্ণর সাহেব অভুক্ত খাদ্য দ্রব্য আলি কেনানকে খেতে দিতেন।
আলি কেনান গভর্ণর সাহেব ঘুমোলে তাঁর ব্যক্তিগত টেলিফোন কলগুলো রিসিভ করতো। কোনো কারণে সাহেবের মন খারাপ থাকলে বা মেজাজ খিঁচড়ে গেলে টেলিফোনের অত্যাচার থেকে তার নির্জনতা রক্ষা করাও তার একটা দায়িত্ব ছিলো। গভর্ণর সাহেবের হামসায়াদের মধ্যে কেউ কেউ আলি কেনানকে বিশেষ পছন্দ করতো না। গভর্ণর সাহেবের একটি বাঁকা বাঁশের লাঠি ছিলো। সেটিকেও ঘনিষ্ঠদের অনেকে মনে করতেন একেবারে বেমানান। লাঠিটির কোনো ছিরিছাঁদ ছিলো না। অনেক সময় ভিখিরিরাও এ ধরনের লাঠি ব্যবহার করে। বন্ধু বান্ধবেরা মনে করতেন গভর্ণর সাহেবের লাঠিটি অধিক সুন্দর এবং সুগঠিত হওয়া উচিত। সোনারুপোর কারুকার্যমণ্ডিত চন্দন কাঠের লাঠি হলেই গভর্ণর সাহেবের জন্য মানানসই হয়। এরকম একটি লাঠি সগ্রহ করে দেয়ার অঢেল মানুষ ছিলো। গভর্ণর সাহেব ইচ্ছে করলেই এরকম একটা লাঠি আপনি এসে হাজির হতো। কিন্তু তাঁকে সে ইচ্ছে কখনো প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। দু একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু, অবসর মুহূর্তে এদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি তাদের ধন্যবাদ দিয়ে একটি গল্প শুনিয়ে দিয়েছেন। গল্প নয় আসলে সত্য ঘটনা। গভর্ণর সাহেবের ওকালতি জীবনের মাঝামাঝি সময়ে এই বাঁশের লাঠির গুণে একবার বিষধর সাপের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। লাঠিটিকে যেমন তেমনি আলি কেনানকেও মানুষ গভর্ণর সাহেবের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ হিসেবে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। আলি কেনান যতো কর্কশ এবং রুঢ় ভাষী হোক না কেনো তার বিষয়ে ইজ্জত সম্মান মান অপমানের প্রশ্ন উত্থাপনের কোনো প্রশ্নই হয় না।