আপনাকে টাকা পয়সা দিতে হবে না। আপনি শুধু পেছনে থাকবেন। আমরা রাস্তায় গাড়ি আটকে টাকা উঠাবো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল তুলবো। বাজারের মহাজনদের কাছে যাবো। এরকম একটি সুন্দর প্রস্তাবে কমিশনারের আপত্তি থাকার কোনো কারণ রইলো না।
আলি কেনানের শিষ্য এবং নিমবাগানের ছোঁকড়ারা বাহুতে মাথায় লাল সালুর ফেট্টি বেঁধে রাস্তায় নেমে পড়লো। প্রতিটি বাস, প্রাইভেট কার থামিয়ে দাবি করতে থাকলো,
খোরাসানি বাবার ওরশ, চাঁদা দিন। কতো টাকা কতো জায়গায় খরচ করেন, দিন আল্লাহর নামে দশ বিশ টাকা দিয়ে যান। গাড়িওয়ালাদের মধ্যেও ঘাউরা লোক কম ছিলো না। তারা অনুরোধ কানে তুললো না। অনেকে দশ পনের টাকার বদলে গাড়িটা অক্ষত ফেরত নিয়ে যেতে পারছে ভেবে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো। আরেক দল বস্তা কাঁধে নিমবাগানের বাড়ি বাড়িতে ধরনা দিতে থাকলো। আগামী তেইশে মাঘ খোরাসানি বাবার মাজারে ওরশ। সুতরাং চাল দেন, টাকা দেন, যে যা পারেন দেন। একেবারে না করবেন না। আল্লাহ বেজার হবে। টাকা পয়সা চাল এসব মন্দ উঠলো না। কিন্তু তার একাংশ দেশী মদ এবং ব্লু ফিল্ম-এর পেছনে হাওয়া হয়ে গেলো। তারপরেও দু-দুটো গরু তারা কিনতে পারলো। বাজারের মহাজনদের কাছে গিয়ে তেল, মশলা, ডাল এবং অন্যান্য জিনিসপত্তর খুব অনায়াসে জোগাড় করে ফেললো। ব্যবসায়ীরাতে ধর্মকাজে টাকা পয়সা দিতে কৃপণতা করে না।
দেখতে দেখতে আঠারোই মাঘ এসে গেলো। সেদিন সকাল থেকে কাজের অন্ত নেই। নতুন লালসালু দিয়ে মাজার সাজানো হচ্ছে, শামিয়ানা টানানো হচ্ছে। প্রাঙ্গণের ঝোঁপ জঙ্গল পরিষ্কার করা হচ্ছে। এতে কাজ করার মানুষ কোত্থেকে এলো কেউ বলতে পারে না। কোরান খতম হচ্ছে, দরুদ পাঠের শব্দ ভেসে আসছে। জোহরের নামাজের পর গরু দুটো জবাই করা হলো। ভিখিরি এবং নগর কাকের চীকারে কান পাতা দায় হয়ে পড়লো। আছরের নামাজের অন্তে খোশবাগ শাহী মসজিদ এবং বায়তুল তুমাম মসজিদের ইমাম সাহেব দুজন এসে মিলাদ পড়ালেন। তারা আল্লাহর মহিমা, নবীর তারিফ বয়ান করার পর কবরে শায়িত মহাপুরুষের রুহের শান্তি কামনা করে মোনাজাত করলেন। মহাপুরুষের দয়ার অছিলায় দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান নর নারীর গুনাহ মাফের আরজ করলেন।
নিমবাগানের চিন্তাশীল মানুষেরা ভেবে দেখলেন ওই মাজারটির নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক মহিমা আছে। নইলে জামানার বুজুর্গ এই সমস্ত বিশিষ্ট আলেম এখানে ফাতেহা পাঠ করতে আসবেন কেনো? অনেকের মন থেকে সন্দেহের শেষ বাম্পটুকুও দূর হয়ে গেলো। মাগরিবের নামাজের পর খাওয়াদাওয়া শুরু। মাত্র দুটো গরু জবাই হয়েছে। অন্যান্য বড়ো বড়ো ওরশের তুলনায় এটা কোনো ব্যাপারই নয়। দীন আয়োজনই বলতে হবে। তবে বড়ো কাজের সূচনা দীনভাবে হওয়াই ভালো। এ বছর দুটো গরু জবাই হয়েছে। তার পরের বছর বিশটা। এমনি ভাবে বাড়তেই থাকবে। ওরশ যতো জমকালো হবে, বাবার মহিমাও ততো ছড়িয়ে পড়বে।
এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি সবাই এসেছিলেন। ভিখিরি যারা এসেছিলো ভর পেট খেতে পেরেছে। তারপরেও বেশ কিছু ভাত এবং মাংস ডেকচির তলায় ছিলো। সেগুলো মাটির সানকিতে করে স্থানীয় সম্ভান্ত লোকদের বাড়িতে বিলি বণ্টন করা হলো। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে এশার নামাজের পর শুরু হলো গান। আলি কেনানের দলটি তো ছিলোই। তাছাড়াও বাইরের একটি কাওয়ালির দল আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলো। রাত ভর গান বাজনা চললো। ছোট্টো একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া তেমন খারাপ কিছু ঘটেনি। সেটা হলো : নিমতলির দুদল ছোকরার মধ্যে চাঁদার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে প্রথমে তর্কাতর্কি তারপর হাতাহাতি। বয়স্করা এগিয়ে এসে মিটমাট করে না দিলে খুনোখুনি পর্যন্ত গড়াতে পারতো। নিমবাগান এলাকায় আলি কেনানের খুব সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। বলতে গেলে আলি কেনানের চেষ্টার পরই খোরাসানি বাবার নাম প্রচার হয়েছে। পুরোনো খাদেমটির কথা ভুলে যেতেও মানুষের সময়ের প্রয়োজন হলো না।
৫. নিমবাগানের মানুষেরা
নিমবাগানের মানুষেরা আলি কেনানকে ফুলতলির বাস উঠিয়ে দিয়ে নিমবাগানে উঠে আসতে যথেষ্ট অনুরোধ করেছে। এখন নিমবাগানের মানুষ তাকে তাদের গৌরব বলে ভাবতে আরম্ভ করেছে। এ কথা আলি কেনানের মনেও একাধিক বার জেগেছে। কিন্তু ফুলতলির বাঁধানো কবরটি ছেড়ে দিতে তার মন চায় না। এই করবটি দিয়েই তার এতোদূর প্রতিষ্ঠা। নাড়ির বন্ধনের মতো ফুলতলির প্রতি একটা টান অনুভব সে না করে পারে না। তা ছাড়া সে ভয়ানক হুঁশিয়ার। সবদিক নিশ্চিত না হয়ে কোনো কাজ করে না। এখনো পর্যন্ত আলি কেনান ফুলতলি আর নিমবাগানে পালা করে যাওয়া আসা করেই কাটাচ্ছে। ফুলতলিতে মাঝেমাঝে অনুপস্থিত থাকলেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ইমাম সাহেব একা চালিয়ে নিতে পারবেন। ইমাম সাহেবের বিস্তর পরিবর্তন ঘটে গেছে। তিনি আলিকেনানের দ্বিতীয় সত্তা হয়ে উঠেছেন। সাদা তহবন্দ এবং বকের পাখার মতো সাদা পাঞ্জাবি পরেন। তাঁর গায়ে গতরে চেকনাই লেগেছে। আগের মিনমিনে ভাবটি আর নেই। লোকজন পরিপূর্ণ আস্থা সহকারে তার হাত থেকে তাবিজ এবং পানি পড়া গ্রহণ করে। আলি কেনানই তো ইমাম সাহেবের প্রাণে ফুঙ্কার দিয়ে তার ভেতর থেকে একজন ব্যক্তিত্বকে টেনে বের করে এনেছে। পাশাপাশি একটা ভয়ও আলি কেনানের আছে। তাবিজ-কবজ পানি পড়া দেয়া ইমাম সাহেবদেরই পেশা। আলি কেনান একজন বহিরাগত। এক নাগারে বেশীদিন যদি সে অনুপস্থিত থাকে তাহলে ইমাম সাহেব তাকে একদিন বেদখল করতে পারে। মক্কেলদের সঙ্গে ইমাম সাহেবের সরাসরি সংযোগ ঘটে গেছে। তিনি ইচ্ছে করলে, তাকে বেদখল করতে পারেন। আলি কেনান জানে ইমাম সাহেবের দিলে এখনো তেমন হিম্মত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মানুষের বদলে যেতে কতোক্ষণ। এসব তো গেলো বাইরের কথা। কেনো সে ফুলতলি ছেড়ে যেতে এখনো প্রস্তুত নয়, তার অন্য একটি গভীর কারণও আছে। সে আর ছমিরন ছাড়া সে কথা কেউ কোনোদিন আঁচ করতে পারবে না। ছমিরনের সঙ্গে অবাধ গোপন মিলনে ব্যাঘাত ঘটে এমন কোনো কাজ সে করতে পারবে না। প্রাণ গেলেও না।