খাদেমের মনে তখনও যথেষ্ট সাহস ছিলো। গত জুমার দিন তিনি নিজের চোখেইতো দেখেছেন আলি কেনানরা কেমন মারটা খেয়েছে। আশা করেছিলেন আজকেও তেমন একটা কিছু ঘটে যাবে। আর শরীরের উত্তেজনাও এসে গিয়েছিলো। তিনি বলেই বসলেন,
বেশী তেড়িমড়ি করলে জান খাইয়া লমু মিয়া, কাইট্যা পড়।
শুয়রের বাচ্চা, খানকির পোলা, গত শুক্কুরবারে কি করছস মনে আছে। অহনও গতরের দরদ ব্যথা যায় নাই। একক্ষণে এ্যাই মাজার থাইক্যা যদি বাইর অইয়া না যাস, খুন কইর্যা পুঁইত্যা রাখুম। সাত সাতজন মানুষ খাদেম সাহেবের দিকে তেড়ে এলো। খাদেম ডানে বামে সামনে পিছনে তাকিয়ে দেখেন, তিনি একেবারে একা। সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তবু কণ্ঠের শেষ জোরটুকু প্রয়োগ করে বললেন,
অ মিয়া আগে ভাগে কইয়া রাখলাম, ভালা অইব না কিন্তু।
শাউরের পুত। তরে ভালা অহন দেহাইতাছি।
আলি কেনান খাদেমের কপালে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো। শিষ্যেরাও ছুটে আসে। খাদেম সাহেব কমজোর মানুষ। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাকে ধরাশায়ী করে ফেলতে তাদের কোনো অসুবিধে হলো না। নিমবাগানের কিছু কিছু কৌতূহলী মানুষ চারপাশে জড়ো হয়ে মজা দেখে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জিগগেস করে,
কি হয়েছে, অমন করে মানুষটাকে মারছো কেনো?
আলি কেনান তার কণ্ঠস্বর এক কাঠি চড়িয়ে বলে,
না মাইর্যা পেয়ার করুম নাকি? আপনেরা এই হারামীরে চেনেন? হারামজাদা খুনি বজ্জাত। ব্যাটা ডাকাইত, মাজারটারে পচাইয়া ফেলাইল। জানেন অর নামে থানায় দশটা মামলা আছে? তার শিষ্যদের নির্দেশ দিলো,
এই নাপাক জন্তুটারে ব্যাবাকডিতে বাইরে থুইয়া আয়। শাউরের পুত মনে থাকে য্যান, মাজারে আবার যদি দেখি জান খাইয়া ফেলামু। যথেষ্ট মানুষ জমা হয়েছিলো। ইচ্ছে করলে খাদেম আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারতেন। আলি কেনানরা তাকে মেরেছে, খুনি বলেছে, ডাকাত বলেছে, বলেছে থানায় মামলা আছে। তিনি কেনো চুপ করে থাকলেন, তিনিই বলতে পারেন। তাঁকে নিরুত্তর দেখে লোকজনও এগিয়ে এলো না। কেউ কেউ মনে করলো, হয়তো লোকটার অতীত খুবই খারাপ। গর্হিত কোনো কাজ করে মাজারে ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছে। খাদেমকে তাড়ানোর পর আলি কেনানের দলবল মাজারে প্রবেশ করে আল্লাহ আল্লাহ শব্দে জিকির করতে থাকে। নিম বাগানের কিছু কিছু মানুষ মনে করলো, তাদের মহল্লার মাজারটির নিশ্চয়ই কিছু আছে। নইলে পাগল দরবেশের দল কি আর শুধোশুধি জিকির করতে আসে। আলি কেনানেরা চীকার করে জিকির করতে করতে মুখে ফেনা তোলে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর লাইলাহাইল্লাল্লাহ শব্দে দ্বিতীয় দফা জিকির আরম্ভ করে। জিকির শেষ করে আলি কেনান শিষ্যদের সামনে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে বললো,
তগোরে কইছিলাম না, বাবায় কখনো মিছা খোয়াব দেহায় না। অহন ত তরা চউকের সামনে পরমান পাইয়া গেলি। এই জানোয়াররে আমরা বাইর কইরা দিছি। অহন মাজার আমাগো।
আলি কেনানের অট্টহাসি আসতে চায়। আল্লাহ যা করে ভালার লাইগ্যা করে। হেইদিন হেই কাণ্ড না ঘটলে, আইজকার ঘটনা ঘটত না। মাজার আলি কেনানদের দখলে চলে এলো।
আলি কেনান চরের মানুষ। কোনো জিনিস দখল করলে কি করে রক্ষা করতে হয় তা সে ভালোভাবেই জানে। সে শিষ্যদের মধ্যে তিনজনকে সার্বক্ষণিকভাবে নিমবাগানের মাজারে মোতায়েন রাখলো। সেও প্রায় প্রতিদিন বেলা দশটার সময় রিকশায় চেপে ফুলতলি থেকে এখানে এসে হাজির হয়। প্রথম চার পাঁচদিন তারা আশেপাশের লোকজনকে জানিয়ে দিলো :
আগে যে মানুষটি এই মাজারে থাকতো সে একটা খুনি ডাকাত। থানায় তার নামে দশ বারোটা খুনের মামলা আছে। জনমত তো সবসময় হাওয়ার অনুকূলে চলে। তারা ধরে নিলো ব্যাপারটা সত্য হতেও পারে। কেউ কেউ অবাক হয়ে চিন্তা করলো, এতদিন এই খাদেম লোকটা তাদের বোকা বানিয়ে গেছে। আল্লাহর দুনিয়াতে কতো রকমের যে ভেল্কিবাজ আছে।
আলি কেনান বসে থাকার মানুষ নয়। ইতিমধ্যে সে নিমবাগানের ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে ফেলেছে। এলাকার আরো কিছু প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে তার জানপাহচান হয়ে গেছে। কিছু বখাঠে এবং বেকার যুবক কিশোরও তার সঙ্গে জুটে গেলো। আলি কেনান ছোঁড়াদের কানে মন্ত্র দিয়েছে। আগামী পাঁচই রজ্জব মাঘ মাসের তেইশ তারিখে খোরাসানি বাবার মাজারে ওরশ করতে হবে। ছোঁকড়ারা গিয়ে কমিশনারকে ধরেছে। আমরা মাঘ মাসের তেইশ তারিখ খোরাসানি বাবার মাজারে ওরশ পালন করবো। আপনাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে।
কমিশনার সাহেবের ছোঁকড়াদের সঙ্গে থাকতে কোনো আপত্তি ছিলো না। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলেন ছোঁড়ারা তাঁর কাছে একটা গরু কিংবা খাসীর দাম দাবী করে বসবে। এই আশঙ্কায় তিনি উশখুশ করছিলেন। তিনি আপত্তি করে বললেন,
হঠাৎ করে ওরশ কি ব্যাপার? ছোঁকড়াদের একজন বলে বসলো,
কোনোদিন ওরশ হয়নি বলে এবার ওরশ হবে না, তার কোনো অর্থ থাকতে পারে না। আপনি এটা কি কথা কইলেন, আপনি কোনো দিনতো কমিশনার হননি। এইবার হয়েছেনে। সত্য কিনা কন? বলে রাখলাম, আমরা এবার ওরশ করবো, আপনাকে পেছনে থাকতে হবে।
কমিশনার বুঝে গেলেন, তিনি রাজী না হলেও ওরা ওরশ করে ফেলবে। তাই কথা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,
না না আমি সে কথা বলিনি। তবে এখন টাকা পয়সার খুব টানাটানি চলছে কিনা, তোমরা যদি টাকা পয়সা দাবী করে বসো আমার দেবার ক্ষমতা নেই। ছোঁড়ারা বললো,