এত কিছুর পরও আলি কেনানের মনের দ্বিধার ভাবটা কাটলো না। জেলফেরত আসামী কালামের মুখে একটুও ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলোনা। শুরু থেকেই আলি কেনানের মনে বেজেছে এই কালাম হারামজাদা তার কথায় বিশ্বাস করে না। এমনকি মনে মনে তাকে একটা দাগাবাজ ভাবলেও সে বিস্মিত হবে না। মানুষের মনের ভাষা পাঠ করার ক্ষমতা না থাকলে সে এই অল্প দিনে এতো দূর প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারতো না। কালাম এখানে থাকলে খেতে পায় বলেই আছে। তার মনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো মতলব আছে। তথাপি আলি কেনান তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি। তাহলে দলটি কানা হয়ে যায়। আরো একটি বিষয় চিন্তা করার আছে। কালামের গানের গলাটি ভারী মিষ্টি।
আলি কেনান হুঙ্কার দিয়ে বললো,
এ্যাই শালা কালাম্যা। এত কি ভাবতে আছস? শুনলি বাবা বু আলি কলন্দর কি কইয়া গেছেন। অহন তোরা কি করবি, হেইড্যা ক?
কালাম কোনো রকম দ্বিধা না করেই বললো,
তা অইলেতো মারামারি করতে অয়। আর মারামারি কইর্যা আমরা পারুম কেনে। অরা অনেক। একবার খাদেমের মাইনসে আমাগো খেদাইয়া দিছে। আপনে কি করবার চান, আপনে জানেন, আমি কিছু কইবার পারুমনা। তাকে কথা বাড়াতে না দিয়ে আলি কেনান বলে বসলো,
হ হাঁছা কতাই কইছস। আমি বাবা বু আলি কন্দরের হাতের বাঁশি। তিনি যেভাবে বাজান, আমি সেভাবে বাজি। আর তরা আমার হাতের যন্ত্র। যা করবার কমু, করবি? কেউ তখন আলি কেনানের প্রতিবাদ করলো না। সুতরাং সে নিশ্চিত হয়ে তার পরিকল্পনাটা প্রকাশ করে। আমরা হগলে যাইয়া আগামী শুক্রবারে মাজারের দখল লইয়া লমু। আমাগো উপর বাজানের দোয়া আছে। কুনু বাপের ব্যাটা ঠ্যাহাইতে পারতো না। বাজান যা যা কইছেন আমরা হগলডি মাইন্যা চলুম। ঐ মাজারে আমরা তামুক টামুক খামু না। এশার নামাজের আগে গান বাজনা করুম না। আর ভেড়া লইয়া যামু। বাজান কইছেন, ভেড়া পাক জন্তু। তরা জখম টখম সারাইয়া ল।
কালাম বলেই বসলো,
অরা অনেক, আমরা মাত্র সাতজন।
আলি কেনান ধমক দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিলো।
শালা চোরা, তর দিলে ইমানের তেজ নাই। বাবা মঈনুদ্দিন একলা আইসা তামাম হিন্দুস্তানে ইসলাম জারী করছে। ইমানের বলে অসাধ্য সাধন করা যায়। তারপরে আর কারো কিছু বলার থাকে না।
ফজল আর মুন্নাফ গাবতলির হাটে গিয়ে দুধের মতো সাদা ধবধবে একজোড়া ভেড়ার বাচ্চা কিনে আনে। আলি কেনান নিজে দাঁড়িয়ে তাদের গোসল করানো দেখলো। তারপর রোদে বেঁধে রেখে গা শুকিয়ে নেয়া হলো। লোমগুলো একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেলে দুটি গামলাতে রং গুলে একটাকে সামনের দিকে সবুজ এবং পেছনে লাল রং লাগানো হলো। আর অন্যটাকে পেছনের দিকে নীল এবং সামনের দিকে হলদু রং মাখিয়ে দেয়া হলো। গলায় চামড়ার বেল্ট পরিয়ে ঘণ্টি লাগানো হলো। চার পাঁচদিন ধরে শিষ্যরা শিকল ধরে শহরের রাস্তায় ভেড়ার বাচ্চাদের হাঁটা চলার টেনিং দিলো।
শুক্রবার দিন ঠিক জুমার নামাজের পূর্ব মুহূর্তটিতে আলি কেনানেরা সদলবলে নিমবাগানের খোরাসানি বাবার মাজারে এসে হাজির হলো। কোনোরকম বিলম্ব না করেই সকলে নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে তাদের দিকে তাকায়। দুয়েকজনের অনুতাপও হয়। তারা গত শুক্রবারে এই ফকিরদের গায়েই হামলা করেছে। কার দিলের ভেতর কি আছে সেতো আল্লাহ জানেন। পারতপক্ষে কেউ বিকেকের কাছে দায়ী হতে চায় না। সুতরাং নামাজ শেষে যে যার মতো ঘরে চলে গেলো।
আলি কেনানেরা মসজিদে প্রবেশ করার সময় ভেড়ার বাচ্চা দুটোকে মাজারের সামনে শ্বেত করবী গাছের সঙ্গে বেঁধে গিয়েছিলো। গত শুক্রবারেও তারা কুকুরটিকে এই নিমবাগানের মাজারেই রেখে গিয়েছিলো। বেচারী আহত কুকুর সেই থেকে এখানেই পড়ে আছে। কুকুরসুলভ ঘ্রাণশক্তি দিয়ে বোধ করি বুঝতে পেরেছিলো, আলি কেনানের অন্ন আর তার ভাগ্যে নাই। ভেড়ার বাচ্চা দুটো দেখে কুকুরের প্রতিশোধ স্পৃহা জাগ্রত হওয়া একটুও অস্বাভাবিক নয়। তাই হা করে ভেড়ার বাচ্চা দুটোকে কামরাতে ছুটে আসে। রং করা ভেড়ার বাচ্চা দুটো প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চীৎকার করতে থাকে। ভাগ্যিস তখন নামাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। নইলে আজকে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারতো।
খাদেম মাজারেই ছিলেন। আসলে তিনি আলি কেনানের কাজ কর্মের ওপর নজর রাখছিলেন। তিনি অসম্ভব রকম ক্ষেপে গিয়ে আলি কেনানকে বললেন, অ মিয়া তোমার মনে কি আছে কওতো দেহি? একবার আস কুত্তা লইয়া, একবার আস ভেড়া লইয়া। মাইর খাইয়াও তোমার শিক্ষা অইলো না? মাজারটারে নাপাক না কইর্যা ছারবানা দেখছি। তোমার মতি গতি ত সুবিধার নয়।
আলি কেনান এটাই চেয়েছিলো। সে খাদেমকে বলে,
তোর কথা শেষ অইছে?
খাদেম বললেন,
এইখান থেইক্যা কাইট্যা পড়। আর কুনু দিনই এইমুখি আইবানা। আইলে পিডের ছাল থাকতনা। আলি কেনান তার আপন স্বরূপ প্রকাশ করলো।
খানকির পোলা, তর বড় বাড় অইছে। আর বাড়তে দিমুনা। বাবা বু আলি কলন্দর আমারে খোয়বে আইস্যা কইয়া গেছেন খোরাসানি বাবা বু আলি কলন্দরের মুরিদ আছিলো। বাবায় কইছেন, তুই মাজার নাপাক কইর্যা ফেলবার লাগছস। তরে মাজার থেইক্যা তাড়াইয়া দিবার হুকুম দিছেন। কুত্তা আছিল নাপাক জন্তু, হের লাইগ্যা কুত্তারে তর কাছে রাইখ্যা গেছি। তুইও নাপাক, কুত্তাও নাপাক। এইবার ভেড়া লইয়া আইছি। ভেড়া পাক জন্তু আমাগো দ্বীনের নবী ভেড়ার গোশত খাইতেন।