আলি কেনান বাইরে এসে দেখে হোগলার চাটাইয়ের ওপর লোকজন বসে রয়েছে। আর ইমাম সাহেব একটি জলচৌকির ওপর কাগজ রেখে কোরানের আয়াত লিখছেন। আলি কেনান ভীষণ বিরক্ত হলো। রোজ রোজ একই দৃশ্য ঘুম থেকে উঠে তাকে দেখতে হয়। ইমাম সাহেবকে ডেকে বলে,
ইমাম সাহেব হগলডিরে কইয়া দ্যান, কারো লগে আমি কতা কইবার পারুম না।
ইমাম সাহেব মিন মিন করে বললেন, অনেকে অনেক দূর থেইক্যা আইছে। চইল্যা যাইতে বলা কি ঠিক অইব? কথা না বাড়িয়ে আলি কেনান বলে,
তা অইলে আপনে দেইখ্যা শুইন্যা তাবিজ আর পানি পড়া দিয়া দেন। তার কথা শুনে ইমাম সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন!
আমি দিলে লোকের উপকার অইব?
আলি কেনান বললো,
আপনে নিজেরে এত আদনা ভাবেন কেরে। কলন্দর বাবা স্বপ্নে কইছে, আপনে দিলেও কাম অইব। খুশিতে ইমাম সাহেবের চোখ দুটো নেচে উঠলো। আপনে হাঁছা কইতাছেন?
হ হাঁছা
সে বাইরে এসে রোজকার মতো মনু মনু বলে কুকুর ছানাটিকে ডাকলো।
পরিচিত চিৎকার করে, ঘন্টি বাজিয়ে কুকুর ছুটে এলো না।
কি কারণ? তখনই আলি কেনানের নিমবাগান মাজারের ঘটনাটি মনে পড়ে গেলো। শরীরের ব্যথা বোধকরি নতুন করে তেতে উঠলো। পাশের ঘরে দু-এক জন শিষ্য অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। আলি কেনান হঠাৎ করে ভিন্ন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। স্থির করে ফেললো খানকীর বাচ্চাটাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।
আলি কেনান বাস্তববাদী মানুষ। সবকিছু গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা তার আছে। মাথাটাও ভীষণ পরিষ্কার। সবচেয়ে কম ঝুঁকি গ্রহণ করে প্রতিপক্ষের মারাত্মক ক্ষতি কিভাবে করা যায় সে শিক্ষা যৌবনে চর দখলের সময় সে পেয়েছে। শরীরের স্নায়ুর সমস্ত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঐ বিষয়টি ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে। তখন বিষয়ান্তরে মননানিবেশ করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাটায়। তার মাথায় একটা নতুন পরিকল্পনা বিজলীর শিখার মতো ঝিলিক দিয়ে জেগে উঠলো।
গায়ের জড়তা, ক্লান্তি যথাসম্ভব দূর করে সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। কিছু কিছু সাপ নাকি আছে, ক্ষেপে গেলে লেজের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছোবল মারে। আলি কেনানেরও অনেকটা সেই অবস্থা। সে শিষ্যদের হাঁক দিলো :
এই কালাম, এই বশির, এই ফজলা তোরা হগলে আইয়া হুইন্যা যা। যে দুজন বাড়িতে থাকে, তাদেরও ডেকে আনা হলো। ফজলা খুব কঁকাচ্ছিলো। আলি কেনান তার পরিকল্পনাটা প্রকাশ করতে পারছিলো না। তার একান্ত ইচ্ছে শিষ্যেরা মন প্রাণ দিয়ে তার কথাগুলো শুনুক। সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য বাঘের মত একটা হালুম করলো। সকলে তার দিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকায়। আলি কোন বয়ান করতে আরম্ভ করে :
তোরা বেবাকডিতে হুন, গত রাইতে কলন্দরি বাবার কাছে অনেকক্ষণ ধইর্যা জারজার অইয়া কানলাম। কানতে কানতে ঘুমাইয়া পড়ছি কহন টেরও পাই নাই। এক সময়ে দেহি হুজরাখানা রোশনাইয়ে ভইরা গেছে। আর চাইরদিকে বেহেশতের বাস। আমি চউক মেইল্যা চাইয়া দেহি একডা বুইড়া মানুষ। মুহে সাদা দাড়ি। হাতে লাঠি আর গায়ে আমাগো মতোন শিকল। মুহের দাড়ি থেইক্যা, হাতের লাঠি থেইক্যা রোশনি বাইর অইবার লাগছে। এমুন ছবি আমি আর জিন্দেগিতে দেহি নাই। বুইড়া মানুষডি আমারে কইলো,
আলি কেনান তুই উইঠ্যা খাড়া। আমি কইলাম,
নিমবাগান মাজারে আমারে ধইর্যা কিলাইছে। উঠবার শক্তি নাই। তহন তিনি আমার গায়ে হাতের লাঠি তুইল্যা একটা বাড়ি দিলেন। লগে লগে আমার দরদ ব্যথা সব চইল্যা গেল। আমি বুইড়া মানুষডির পায়ের উপর আছরাইয়া পইরা কইলাম,
বাজান আপনে কেডা? তখন তিনি আমারে সোহাগ কইরা হাত বুলাইয়া কইলেন,
আমার নাম বু আলি কলন্দর। আলি কেনান বলতে থাকে, শিষ্যেরা অবাক হয়ে শুনে। তারপর আমার দুই চউক দিয়া হু হু কইর্যা পানি পড়তে লাগলো। বাবাজান তাঁর পাক হাতে আমার চউকের পানি মোছাইয়া কইলেন,
বেটা আলি কেনান, তর দিলে খুব মহব্বত। আর কান্দনে কাম নাই। আমি কষ্ট পাইতাছি তোগো লাইগ্যা।
আলি কেনান নির্বিকার বলে যাচ্ছিলো। শিষ্যেরা সম্মোহিত হয়ে শুনছিলো। দেখা গেলো ইমাম সাহেবও আয়াত লেখা বন্ধ করে মুগ্ধ বিস্ময়ে আলি কেনানের স্বপ্ন পুরানের কথা শুনছেন। আলি কেনান বলে যায়,
তারপর বাবা আমারে কইলেন, খোরাসানি আমার মুরিদ আছিল। এই ব্যাপারে তার লগে আমার ফাইন্যাল কথা অইয়া গেছে।
ঐ খাদেম বেটা নাপাক বজ্জাত আর হারামি। তুই অরে খেদাইয়া মাজারের দহল লইয়া ল। তিনখান কতা মনে রাখিস। কুত্তা লইয়া যাবি না। অহন আসহাবে কাফের জমানা নয়। অহন কুত্তা নাপাক। জন্তু জানোয়ারে যদি হাউস থাহে, ভেড়া লইয়া যাবি। ভেড়া পাক জন্তু। আমাগো দ্বীনের নবী ভেড়ার গোশত খাইতে পছন্দ করতেন। আর হুন এশার নামাজের আগে গান বাজনা করবিনা। আমার ঘুম ভাইঙ্গ্যা গেল। দেহি শরীরে আর দওর ব্যথা নাই। বেবাক ঘরে ম ম খোশবু। আমি কানতে কানতে কইলাম,
বাজান আরেকবার দর্শন দ্যান। আমার চউকে আর নিদ্রা আইলনা। তরা হুইঙ্গা দেখ অহনও আমার গতরে খোশবু লাইগ্যা আছে। ইমাম সাহেব নাকটা আলি কেনানের আলখেল্লার কাছে নিয়ে গেলেন, হাঁছাইত দেহি, চম্পা ফুলের মত বাস পাওয়া যায়। বু আলি কলন্দর যে স্বপ্নে দর্শন দিয়েছেন, সে ব্যাপারে আর কারো সন্দেহ রইলো না।