খাদেম এই আলি কেনান মানুষটিকে শুরু থেকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন। তাদের পোশাক আশাকের জেল্লা, সঙ্গী সাথী এবং সংঘবদ্ধতা খাদেমের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। তিনি মনে মনে চাইতেন আলি কেনান যেনো এই মাজারে না আসে। তার একটা আশঙ্কা ছিলো কোনোদিন আলি কেনানেরা যদি মাজার দখল করে বসে। যদি তাকে তাড়িয়ে দেয়, সে বড়ো দুঃখের ব্যাপার হবে। তিনি অকূলে পড়ে যাবেন। আবার মুখ ফুটে তিনি নাও করতে পারছিলেন না, অলি আল্লার ভক্ত আসবে, সেখানে খাদেম বাধা দেওয়ার কে? তাই তিনি তক্কে তক্কে ছিলেন, যদি কোনো দিন সুযোগ পাওয়া যায়।
আজকে না চাইতেই সেই সুযোগটা হাতের কাছে এসে গেলো। আলি কেনানের অপরাধ সে নামাজের সময় গান গেয়েছে। তাতে মুসুল্লিদের নামাজের ব্যাঘাত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ দলেবলে সে গাঁজা খেয়েছে। তৃতীয়তঃ সবচেয়ে গর্হিত অপরাধ যেটা সে করেছে, ধর্মস্থানে কুকুর নিয়ে প্রবেশ করেছে। কুকুর আমাদের রসুলের জানের দুশমন। মুসল্লিরা প্রচণ্ড রকম ক্ষিপ্ত হয়ে আলি কেনান এবং তার দলবলকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিলো। আলি কেনানের মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিলো। আলি কেনান ক্ষিপ্ত মুসল্লিদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলো কুকুর খুব খারাপ জানোয়ার। কিন্তু মাঝে মাঝে ভালো কুকুরও পাওয়া যায়। যেমন আসহাবে কাফের সঙ্গে একটা কুকুর ছিলো। ক্রুদ্ধ মুসুল্লিরা তার কথা কানে তুলেনি। তারা। কুকুরটিকেও এমন মার দিয়েছে পেছনের পা দুটো একেবারে জখম হয়ে গেছে।
আলি কেনানের সমস্ত রাগ কুকুরটার ওপর পড়ে। সে ধরে নিয়েছে কুকুরটার কারণেই তার এতো লাঞ্ছনা। তাই কুকুরটার পেটে একটা লাথি দিয়ে রিকশায় উঠে বসলো। তাদের সকলের মিরপুরের মাজারে যাওয়া বন্ধ রেখে ফুলতলিতে ফিরে আসতে হলো।
আসার সময় নিমবাগানের খাদেমের দিকে তর্জনী প্রসারিত করে বললো, খানকির পুত মনে রাখিস, তরে একদিন দেইখ্যা লমু।
অতি সংকটেও আলি কেনান কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বসে না। সে তার ভক্তদের বলে:
এই কালাম, এই হাফিজ এই কতা ফুলতলির মানুষদের কইয়া লাভ নাই। মনে থাকবে? শিষ্যেরা মাথা ঝাঁকায়।
সেই রাতে মেয়ে মানুষটি পরম যত্নে তার সেবা শুশ্রূষা করে। গরম পানিতে গামছা ভিজিয়ে সারা শরীরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করে। শরীরের জখমী জায়গাগুলোতে ডাক্তারের দেয়া মলম লাগিয়ে দেয়। আলি কেনান ডান হাতটা নাড়াতে পারছিলো না। মেয়ে মানুষটি নিজের হাতে গ্লাস পাকিয়ে ভাত খাইয়ে দেয়।
ক্লান্তিতে আলি কেনানের চোখ বুজে আসছিলো। মাঝরাতে কি একটা স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙে যায়। দেখে এখনো মেয়ে মানুষটি তার বিছানার পাশে বসে আছে। চোখের দৃষ্টি তার দিকে স্থির। আধো আলো আধো অন্ধকারে মেয়ে মানুষটিকে তার চোখে একটি অনুচ্চ ঝোঁপের মতো মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ করে তার বুকের ভেতর আকাঙ্খ দুলে উঠলো। সে ফিস ফিস করে জিগগেস করে,
এই তর নাম কি করে? মেয়ে মানুষটিও ফিস ফিস করে জবাব দেয়,
আমার নাম ছমিরন। অতি কষ্টে জখমি হাতটা বাড়িয়ে ছমিরনকে তার দিকে আকর্ষণ করে। ছমিরন যেনো সে জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সে আলি কেনানের শরীরের সঙ্গে কাদার মতো লেপ্টে থাকে। সেদিন থেকে ছমিরন এবং আলি কেনানের মধ্যে একটা গোপন শারীরিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলো।
৪. ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে
সেই ঘটনার পরের দিন আলি কেনানের ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে। অনুভব করে সর্বশরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। নড়াচড়া করার শক্তি নেই। তবু সে অনুভব করে একটা প্রশান্তি তাকে আচ্ছন্ন করে আছে। তার আপন অস্তিত্ব পাথর খণ্ডের মতো ভারি মনে হয়।
এদিকে সকালের রাঙা আলো ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে। নতুন সূর্যালোক জাগ্রত ধরিত্রীর রূপরস গন্ধ তাকে ক্রমাগত চঞ্চল এবং উতলা করে তুলেছে। আলি কেনান অনুভব করে এই পৃথিবী সুন্দর। সুন্দর তার প্রসন্ন সূর্যোদয় সুন্দর সূর্যাস্ত। ঘাসপাতা, গাছপালা পাখপাখালি সবকিছু সুন্দর। আল্লাহ মেয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছে বলেই তো এই দুনিয়া এতো রূপরসে ভরা। মেয়ে মানুষ না থাকলে পৃথিবী একটি মরুভূমিতে পরিণত হতো। আলি কেনান শুয়ে শুয়ে অনুভব করে।
এই আকাশ পৃথিবীর কোথায় রসের একটা গোপন উৎসধারা খুলে গেছে। এই ধারা স্রোতে সে যেনো ভেসে যাচ্ছে। সর্ব অস্তিত্বে নিজেকে নবজাত শিশুর মতো পেলব এবং সুকুমার মনে করতে থাকে।
আলি কেনান চোখ বুঝে আছে, তবু টের পায় ছমিরন হুজরাখানায় ঢুকেছে। মেয়ে মানুষের শরীরের আলাদা একটা ঘ্রাণ আছে। সহসা ছমিরনকে দেখার একটা তীব্র গভীর তৃষ্ণা মনের মধ্যে অনুভব করে। গা ধুয়েছে ছমিরন। তার মাথায় আধভেজা চুলের বোঝা পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। দুয়েক ফোঁটা পানি ঘাড়ের কাছটিতে চকচক করছে। মুখে গুটিবসন্তের দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই ছমিরন ঠোঁট ফাঁক করে হাসলো। বাহু দুটো অকারণে নাড়া দিলো। আলি কেনানের মনে হলো,
এই বাহু দুটোর ভাষা আছে। যেনো তারা বলছে, তুমি বাঁধা পড়ে গিয়েছে গো। আর যাবে কোথায়?
আস্তানায় লোকজন আসতে শুরু করেছে। অগত্যা আলি কেনানকে শয্যাত্যাগ করে উঠতে হয়। সে প্রাতঃকৃত্য শেষ করলো। ছমিরন এবারও গরম পানিতে গামছা ভিজিয়ে তার সারাগা মুছে দিলো। দু জনের মধ্যে একটি কথাও বিনিময় হয়নি। আলি কেনান ছমিরনের দিকে তাকাতে পারছিলো না। কোত্থেকে একটা লজ্জা এসে তাকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছিলো। সে বেমালুম ভুলে গেলো, গতকাল তার ওপর একটা বিরাট ঝড় বয়ে গেছে।