জবাবে মেয়ে মনুষটা বললো, বাবা চইদ্দ বছর বয়সের সময় আমার বিয়া অইছে। আপন খসম ছাড়া অন্য কুনু বেডা মাইনসের চউকে চউকে চাইয়া কতা কই নাই। সে আবার আলি কেনানের পায়ের ওপর আছার খেয়ে বলতে থাকলো,
বাবা আমি একা অইলে কুনু ভাবনা আছিল না। পেডের মাইয়াডি গলার কাড়া। হেরে থুইয়া মরবার চাইলেও পারি না। আপনে আমাগোরে উদ্ধার করেন বাবা। এবার আলি কেনানের মেজাজ একটু নরোম হয়।
সে জিগগেস করে,
রাঁধবার পারবি?
হ বাবা পারুম, মেয়ে মানুষটি জবাব দেয়।
এই কুত্তার বাচ্চারে গোসল করাইয়া রং মাখাইবার পারবি?
হ বাবা হগলডি পারুম। কেবল আমার পোড়া কপাইল্যা মাইয়াডারে বাঁচান।
তুই হগলডি পারবি? আলি কেনান অনেকটা ফিস ফিস করে জিগগেস করে। মেয়ে মানুষটি ঘাড় কাৎ করে।
আলি কেনান রাজি হয়ে গেলো। যা অই খালি ঘরটাতে থাক গিয়া। খবরদার লাঙলুঙ ঢুকাইলে শাউয়ার মধ্যে তাজা আঙরা হান্দাইয়া দিমু। সেদিন সন্ধ্যে থেকে আলি কেনান নারীর হাতের রান্না খাওয়া আরম্ভ করলো।
মেয়েমানুষ দুটি আস্তানায় আসার পর থেকে আলি কেনানের উড়ু উড়ু ভাবটি অনেক কমেছে। সে অনুভব করে মাটির সঙ্গে শেকড়ের যোগ যেনো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিজেকে অকারণে পূর্বের চাইতে অনেক ভারী বলে মনে হতে থাকে। মেয়ে মানুষটি অকৃপণ অনুরাগে তার সেবাযত্ন করে। প্রতিদিন দুবার করে ভেতরের ঘর, বাইরের ঘর ঝাট দেয়। হুজরাখানা পয় পরিষ্কার রাখে। আলি কেনানের সারা গায়ে সাবান মেখে গোসল করায়। গোসলের পর গা মুছিয়ে দেয়। গা মোছা সারা হলে সারা গায়ে মাথায় শর্ষের তেল দিয়ে মালিশ করে। যতোই দিন যাচ্ছে, মেয়ে মানুষটি আলি কেনানের জীবনের বাইরের অংশে অধিকার প্রসারিত করছে এবং আলি কেনানও ক্রমশ মেয়ে মানুষটির ব্যবস্থাপনার মধ্যে আত্মসমর্পন করতে থাকে। তার মেয়েটি কচিত ঘরের বের হয়। বাটনা বাটে, তরকারি কুটে, রান্নাসহ ভিতরের সব কাজ করে। আলি কেনান তার হাতের রান্নার তারিফ করে। সে সকাল বিকেল খাওয়ার পর আলি কেনানের জন্য চমন বাহার দিয়ে পান বানিয়ে পাঠায়। আলি কেনানের কাছে সে পান খুব মিঠে মনে হয়।
এখনো আলি কেনান ভক্তদের নিয়ে প্রতি শুক্রবার জুড়ি আর খঞ্জনি বাজিয়ে মাজার পরিক্রমায় বের হয়। কুকুর ছানাটিও তাদের সঙ্গে যায়। হাইকোর্টের মাজার সালাম করে নিমবাগান মাজারে এসে খাওয়া দাওয়া সারে। সে দিন গাঁজায় দম দিয়ে আলি কেনানের মনে হলো তার জীবনে এতো সুখ রাখবার কোনো জায়গাই নেই। ভক্তদের নির্দেশ দিলো,
এ্যাই কালাম, এ্যাই বশির গানে টান দে। ভাব আইবার লাগছে। তখন সবকিছুর দুঃখ ভুলে গিয়ে তারা গাইতে লাগলো :
জলিল ও জব্বার বাবা
জলিল ও জব্বার
তোমার প্রেমেতে হলো
দুনিয়া গুলজার।
পেয়ে তোমার প্রেমের মধু
কুল ছাড়িল কুল বধু
অসাধু হইল সাধু
প্রেমেতে তোমার।
আলি কেনান জানতো না যে সে একটা বড়ো ধরনের ভুল করে বসে আছে। তখনো শুক্রবারের জুম্মার নামাজ শেষ হয়নি। নামাজের সময় গান বাজনা। স্বভাবতই মুসুল্লিদের কেউ কেউ ভীষণ ক্ষেপে উঠেছিলো। মাজারের খাদেমও এই রকম একটা সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলো। নিমবাগানের মাজারটির পেছনে কোনো জমকালো ইতিহাস নেই। কোন্ সাধু পুরুষের দেহাবশেষের ওপর এই মাজার জন্ম নিলো, তার নামটিও আশ পাশের মানুষ ভালো করে বলতে পারে না। খাদেম অবশ্য ইদানিং একটা লম্বা চওড়া সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন- হজরত আমজাদ আলি শাহ খোরাসানি (রাঃ) এর মাজার। এই খোরাসানি বাবা সম্পর্কে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলে খাদেম একটা দীর্ঘ বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিয়ে থাকেন। কাহিনীটি বার আউলিয়ার চরিত কথা নামক পুস্তক থেকে সংগ্রহ করে, স্থান বিশেষে সম্পাদনা করে খোরাসানি বাবার নামে চালিয়ে থাকেন। খাদেমের মতে হজরত খোরাসানি বাবা বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের পর পরই সুদূর খোরাসান থেকে আপন পীরের নির্দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই বাংলা মুলুকে আসেন এবং এইখানে দেহ রক্ষা করেছেন। বাবার দুয়েকটা কেরামতির কথাও অবস্থা বুঝে প্রকাশ করেন। কেউ বলে,
বাবাজান কুমীরের পিঠে সওয়ার হয়ে এসেছিলেন। আবার কারো মতে, একটা মানুষ খেকো বাঘ পিঠে করে তাঁকে বয়ে এনেছিলো।
এই নিমবাগানের মাজারের খাদেমের শত্রুর অভাব ছিলো না। তাদের কেউ বলতো, একটা মামুলি কবরের ওপর এই মাজার উঠেছে। আবার কেউ কেউ খাদেমের বিগত জীবন নিয়ে নানা কথা উত্থাপন করতো। সেসব খুব একটা ধর্তব্যের ব্যাপার নয়। খোরাসানি বাবা এখানে দেহ রক্ষা করেছেন কিনা সেটাও বড়ো কথা নয়। আসল ব্যাপার হলো মানুষের মনে অচলা ভক্তি আছে, সেই ভক্তি কোথাও নিবেদন করতে হবে। মানুষের ভক্তি এবং খাদেমের অক্লান্ত প্রয়াসে এই সুন্দর মাজারটি এই নিমবাগানের মাটি খুঁড়ে জন্মাতে পেরেছে। মানুষের জীবনে সমস্যা আছে, আছে দুঃখ ও শোক। তারা যাতে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারে সে জন্য মাজারের পেছনে একটা জমাট ইতিহাসও চাই। এই খাদেমের কৃতিত্ব হলো সেই ইতিহাসটি লোকগ্রাহ্য করে তুলতে পেরেছেন।
খাদেমকে কেউ নিয়োগ করেনি। তিনি স্বয়ং নিযুক্ত হয়েছেন। মাজারের কোনো কমিটি নেই। তিনি একাই সব। সবেতো মাজারের জন্ম হলো। এতো তাড়াতাড়ি কমিটি আসবে কোত্থেকে? অবশ্য তাঁর নিযুক্তির দাবির পেছনে একটা স্বপ্ন নির্দেশের কথা বলে থাকেন।