ফুলতলি মসজিদের ইমাম এবং শাহ আলি বাবার মাজারের বুড়োর কাছে সে অনেক কিছু শিখেছে। মাঝে মাঝে চোখ বুজে চিন্তা করে। তখন তার মনে হয়, সে সোজা কিংবা বাঁকা যে কোনো পথে যাক না কেনো, সর্বক্ষণ একটা ইতিহাসের ধারাকেই বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলেও সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। একটা না একটা ধারা এসে টেনে নিয়ে যায়। সে দরবেশের অভিনয় করছে, কিন্তু তার মধ্য দিয়েও সমস্ত দরবেশের সাধনার ধারা পাহাড়ী নদীর মতো ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে আছড়ে পড়ে তাকে গ্রাস করে ফলেতে চাইছে। দুনিয়াটা বড়ো আশ্চর্য জায়গা।
ইমাম সাহেবের কাছ থেকে সে শরিয়তের নানা বিষয়ের বিস্তর সংবাদ সংগ্রহ করেছে। আর বুড়ো স্থূল জগতের মধ্যে যে আরেকটা সূক্ষ্ম জগৎ আছে সে বিষয়ে তাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। আলি কেনানের গ্রহণশীলতার তুলনা নেই। সে যা শুনতে চায়, তাই-ই শুনে। তার সবকিছুই কঠোর প্রয়োজনের নিগরে বাঁধা, তার বাইরে একচুল যেতেও তার মন প্রস্তুত নয়। সে বুড়ো কিংবা ইমাম সাহেব কারো কাছে আত্ম সমর্পণ করে বসেনি। সে যে ধর্মকর্ম-এসব বিষয়ে অধিক জানে না, একথা জানান দিতে আত্মসম্মানে বাধে। হাজার হোক জানাশোনার সঙ্গে কর্তৃত্বের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তো আছে। তাই দৈনন্দিন আলাপে সালাপে যতোটুকু জানতে পেরেছে, তাই নিয়ে সে সন্তুষ্ট। তার প্রয়োজন ছাড়া কোনো বিষয়ে সে বেশি শিখতে চায় না। বেশী শেখার বিপদ আছে। তাহলে তাকে হয়তো ইমাম সাহেব কিংবা বুড়োর মতো হতে হবে। সে ধরনের জীবন সে গ্রহণ করতে পারে না। জীবনকে পাকা সুপুরির মতো সবসময় একটা নীরেট বস্তু হিসেবে দেখে। সে চরের মানুষ। দাপটের সঙ্গে বাঁচাই তার আবাল্যের স্বভাব। ‘মারো অথবা মরে যাও’ এই হলো তার কাছে জীবনের সংজ্ঞা। এই বাঁচার কি আনন্দ, কি সুখ বুড়ো কিংবা ইমাম সাহেব তা জানেন না। আলি কেনান অনেক তত্ত্বকথা শুনেছে বটে, কিন্তু বাস্তব কাজে অবহেলা করেনি। ফুলতলির আবাসস্থলটিতে কিছু কিছু সংস্কারের কাজ সে করে ফেলেছে। হুজরা খানার সংলগ্ন ফাঁকা জায়গাটিতে আরো দুটি নতুন ঘর উঠিয়ে নিয়েছে। দুজন মেয়ে মানুষ, মা ও মেয়ে তার আস্তানায় এসে জুটেছে। সে অবাক হয়ে ভাবে তার যা প্রয়োজন আল্লাহ নিজে তা পাঠিয়ে দেন। আল্লাহ যে রহমানুর রহিম বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। তাকে ঘিরে ফুলতলিতে যে কর্মচক্র সৃষ্টি হয়েছে, মাঝে মাঝে তার মধ্যে নিজেকে বন্দি বলে মনে করে। এতো ছলাকলা এতো কলকৌশল এসবের কি কোনো প্রয়োজন আছে? একটাইতো জীবন! একভাবে না একভাবে কাটিয়ে দেয়া যায়। যতো লাল সালুর আলখেল্লা পরুক দাড়ি গোঁফ বড়ো করে রাখুক, আলি কেনান জোয়ান মানুষ। একটি মেয়ে মানুষের অভাবও সে তীব্রভাবে অনুভব করে।
তার অভাবগুলোও যে তীব্র। একেবারে জমাট বাঁধা। কিছুতেই অন্যবস্তু দিয়ে পূরণ করা যায় না। ভোলা থেকে সেই পুরোনো বউটিকে ফিরিয়ে আনার কথাও তার মনে এসেছে। সেটা অসম্ভব মনে করে তাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়েছে। সাপের পুরোনো খোলসের মতো সেই জীবন সে ফেলে এসেছে। কাঁচা ঘরের কড়ি বরগা যেমন পাকা ঘরের কোনো কাজে আসে না, তেমনি ভোলার জীবনের কোনো কিছুই তার আর কাজে আসবে না।
একদিন হুজরাখানা থেকে বেরিয়ে আচমকা আলি কেনান চমকে ওঠে। তখনও লোকজন আসতে শুরু করেনি। আলি কেনান দেখে দুজন মেয়েমানুষ হোগলার ওপর বসে আছে। তাদের মধ্যে একজনের বয়স চল্লিশ টল্লিশ হবে। মুখে কয়েকটি গুটি বসন্তের দাগ। শরীরের বাঁধুনি এখনো বেশ শক্ত। অন্য মেয়েটির বয়স আঠারো থেকে বিশের মধ্যে। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা না হলেও মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে। গরিব ঘরের মেয়ে ঠিকমত খেতে পরতে পারলে গায়ের রং যে আরো খোলতাই হবে তাতে সন্দেহ নেই। আলি কেনান তার স্বভাবসিদ্ধ কর্কশ ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করলো,
এ্যাই তোরা কি চাস? তবু তার গলার স্বর বুঝি একটু কাঁপলো। রয়স্কা মেয়ে মানুষটি তার পায়ের ওপর আছার খেয়ে বললো,
বাবা আমারে বাঁচান। আলি কেনান এই মুহূর্তটিতে বাবা ডাকটি শুনতে চাইছিলো না।
সে বললো,
মাগি তামাসা রাখ। কি অইছে হেইডা ক।
মেয়ে মানুষটি কেঁদে কুটে অনেকক্ষণ কসরত করে যা বললো, তার সারমর্ম এরকম :
মেয়েকে নিয়ে সে বস্তিতে থাকে। সোয়ামী চটকলে চাকুরী করতো। বছর দুই হলো মারা গিয়েছে। তারপর থেকে মা মেয়ে এই বস্তিতে ডেরা পেতে আছে। মা মেয়ে দুজনই পরের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটায়। এই পেটের মেয়েই এখন তার কাল হয়েছে। মেয়ের কারণে, তাদের দিকে বস্তির খারাপ মানুষদের দৃষ্টি পড়েছে। গত রাতে আট দশজন মানুষ তার মেয়েকে লুট করে নিয়ে যাওয়ার জন্য হানা দিয়েছিলো। তারা তাকে জানে মেরে ফেলবে বলে ভয়ও দেখিয়েছে। বহু কষ্টে ঘরের পেছনের বেড়া ভেঙে চুপিচুপি আর একটা ঘরে গিয়ে রাত কাটিয়েছে। এখন বস্তির কেউ আর তাদের আশ্রয় দিতে রাজি নয়। বেহুদা পরের জন্য নিজের বিপদ ডেকে আনতে কে রাজী হবে! বাবা দয়া করে আশ্রয় না দিলে এই সংসারে তাদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
আলি কেনান আবার চীৎকার দিলো,
মাগি তর লাঙ ঢুকাইবার স্বভাব আছে? কহন যায়না মাগিগো লগে শয়তান ঘুইরা বেড়ায়।