সারা দিন মাজারের দান বাক্সে যতো টাকা পড়ে, সন্ধ্যেবেলা সে টাকা নিলামকার মহাজনের বাড়িতে চলে যায়। যতো লোক রক্ষণাবেক্ষণে থাকে সব মাইনে করা কর্মচারী। জিলিপি, রসগোল্লা, আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল যতো মাজারে আসে সব পিছনের দরজা দিয়ে ঘুরে আবার দোকানে চলে যায়। একেক দিনের মধ্যে এক সের মিষ্টি যে কতোবার কেনা বেচা হয় কেউ হিসেব রাখতে পারে না। কেবল বিক্রির অর্থটাই জমা হয় মহাজনের সিন্দুকে। প্রতিটি মাজার নিজের নিয়ম কানুনে চলে। এখানে সরকারের আইন বিশেষ কাজ করে না। গাঁজা, চরস, সিদ্ধি এসব অবাধে কেনাবেচা হয়। পুলিশের খপ্পরে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। সে কারণে তাদের নিলামকারকে চড়াহারে কমিশন দিতে হয়।
আলি কেনান দেখেছে মাজারে শায়িত মহাপুরুষদের বংশধরদের মধ্যে মাজারের দখল নেয়ার জন্য কি তীব্র প্রতিযোগিতা। এক শরিকের মুরিদ আরেক শরিককে বাগিয়ে নিতে কোনো রকমের বিবেক দংশন অনুভব করে না। খুন জখম হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। মামলা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। বছরের পর বছর চলতে থাকে। এই সমস্ত কাহিনী মানুষ জানে, তবু তারা মাজারে আসে। স্বর্গবাসী পুরুষের মুক্ত চেতনার সঙ্গে পৃথিবীর শকুনিদের লোভ লালসা এক করে না দেখার আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষের আছে। তাই তারা মাজারে আসে।
গভর্ণর হাউজে থাকার সময় আলি কেনান খুব নিকট থেকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। এই লাইনে আসার পর থেকে তার মনে হতে থাকে ওইখানে এই মাজারে সেই দ্বন্দ্বটি কম নয়। তবে সূক্ষ এবং ঘেরাটোপের আড়ালে ঢাকা থাকে।
শাহ আলী বাবার মাজারে আলি কেনান প্রতি শুক্রবার দলবল নিয়ে গান বাজনা করতো। সঙ্গীতের একটা নিজস্ব দাহিকা শক্তি আছে। যারা শুনে বাহবা দেয়, তাদের যেমন সংসার যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখে, তেমনি যারা গায়, বাজায় তাদেরও সব ভুলতে বাধ্য করে। আলি কেনান নিজেকে এই সম্মোহন থেকে মুক্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতো। কিন্তু সফল হতে পারেনি। তার জীবনের এটা একটি দুর্বলতার দিক। এমনও হয়েছে, কোন্ দিক দিয়ে রাত শেষ হয়ে গেছে, টেরও পায়নি।
বিরাট বট গাছটির বাঁধানো চত্বরে আলি কেনানের দলটি গান করতো। সাধারণত এ জায়গায় কাউকে গান করতে দেয়া হয় না। আলি কেনানের দলটি খুব। ভাল গায় বলে এই বিরল সুযোগ পেয়েছে। অজগর সাপের মতো বট গাছের শেকড়ে হেলান দিয়ে একটা বুড়ো মানুষ বসে থাকে। বয়স বোধকরি সত্ত্বর পঁচাতুর হবে। এখনো শক্ত সমর্থ আছে। বগলে দুটো লাঠি ভর দিয়ে বুড়োকে চলাফেরা করতে হয়। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক বারমাস বুড়ো শেকড়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে। কারো কাছে কিছু একটা সাধারণত দাবি করে না। লোকজন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অনেক সময় টাকা, আধুলি সিকিটা এনামেলের প্লেটে দিয়ে যায়। লোকটাকে দেখলেই মনে হবে বট গাছটির মতই প্রাচীন এবং একাকী।
ধীরে ধীরে এই মানুষটির সঙ্গে আলি কেনানের পরিচয় জমে ওঠে। আলি কেনান ভীষণ অহংকারী এবং উদ্ধৃত প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু বুড়োর মুখোমুখি দাঁড়ালে বিচলিত বোধ না করে পারে না। তার উগ্র স্বভাবটি আপনাআপনি সংযত হয়ে আসে। দুজনের মধ্যে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হতে অবশ্য দীর্ঘ সময় লেগেছে। একদিন বুড়ো আলি কেনানকে জিজ্ঞেস করে,
অ মিয়া তোমরা হগলে দিনরাতই এই শিকলের বোঝা কেমন কইরা বও?
আলি কেনান একটুও না ভেবে জবাব দিলো,
এইডা আমাগো চিন্ন। বুড়ো ফের জিজ্ঞেস করে,
কীয়ের চিন্ন?
আলি কেনান বলে, বু আলি কলন্দর তরিকার চিন্ন। বুড়োর মুখে রসিকতা ঝিলিক দিয়ে ওঠে :
বু আলি কলন্দরের কতা থাউক, তরিকা কারে কয় হেইডা বোঝনি?
আলি কেনান সত্যি সত্যি লা জওয়াব হয়ে যায়। বুড়োর কাছেই প্রথম জানতে পারে তরিকার অর্থ হলো পথ। ঢাকা শহরে যতগুলো রাস্তা, লেন, বাইলেন আছে ইসলাম ধর্মের ততোগুলো তরিকা আছে। সব নদী যেমন সাগরে গিয়ে মিশে, তেমনি সব তরিকা আমাদের দ্বীনের নবী মুহম্মদের মধ্যে মিশে গিয়েছে। তিন লাখ সতুর হাজার পয়গম্বরের সর্দার আমাদের নবী। আর সমস্ত আউলিয়া কুলের সর্দার। হলেন হজরত আব্দুল কাদির জিলানি। হযরত আবদুল কাদির জিলানির দুই কাঁধের ওপর স্থাপিত আমাদের দ্বীনের নবীর কদম মোবারক এবং তামাম আউলিয়া কুলের কাঁধের ওপর চরণ রেখেছেন হযরত আবদুল কাদির জিলানি। বেবাক হিন্দুস্থানে যত আউলিয়া বুজুর্গ আছেন, তাদের সর্দার হলেন হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি। তিনি গরিব গোবরার দোস্ত এবং হিন্দুস্তানের সম্রাট। এই যে শাহ আলী বাবার মাজার দেখতে আছো তিনিও খাজা বাবার সিলসিলার বুজুর্গ।
এসব কথা আলি কেনান রূপকথার গল্পের মতো শুনে। সব কথা তার বিশ্বাস হতে চায় না। তবু বুড়োর বলার ধরনের মধ্যে এমন একটা ভঙ্গী আছে, সেখানে সম্ভব অসম্ভব বাস্তব অবাস্তবের মধ্যবর্তী সীমারেখা হারিয়ে যায়। তার মনে এক আধটু ভাবান্তর আসে। মাঝে মাঝে মন ছুঁড়ে একটা প্রশ্ন জাগ্রত হয় :
মানবজীবন- এর কি কোনো উদ্দেশ্য আছে? গরম বালুতে পানি পড়লে যেমন হারিয়ে যায়, তেমনি কোনো কিছুই তার মনে স্থায়ী হয় না। গত্বাঁধা পথে জীবন চলতে থাকে। মানুষ জন এলে তাবিজ দেয়। কুকুর ছানাটি নিয়ে আদায়ে বের হয়। আজকাল টাকা পয়সার তাগাদায় তার বের না হলেও চলে। তথাপি সে নিয়ম ভঙ্গ করে না। সম্প্রতি আলি কেনানের মধ্যেও একটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। বাইরে তার প্রকাশটি খুব স্পষ্ট নয়।